দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি বিবেচনায় ভোজ্য তেল, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজের মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে চাল ও গমের আমদানি ‘মারাত্মকভাবে’ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। জ্বালানিসংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে নিত্যপণ্যের জোগানে (পাইপলাইন) ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে।
বিজ্ঞাপন
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মজুদ ও সরবরাহ লাইনের বিবেচনায় চিনি আগামী তিন মাস এবং ভোজ্য তেলে চার মাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ ছাড়া গম আমদানি কম হওয়ায় আটা ও ময়দার বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ‘কতিপয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন, আমদানি ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
কমিশন সূত্রে জানা যায়, ভোগ্য পণ্যের বাজারে সংকট মোকাবেলায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনার জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপপ্রধান (চলতি দায়িত্ব) মো. মাহমুদুল হাসন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্বালানিসংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানি পণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে নিত্যপণ্যের জোগানে ঝুঁকি তৈরি করেছে। চিনিসহ অন্য পণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রাখতে চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ কমছে। এটা মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন।
চিনির বাজার স্বাভাবিক রাখতে আমদানিতে আরোপিত নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার পরামর্শ দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।
ভোজ্য তেল, চিনির চাহিদা ও সরবরাহ
ভোজ্য তেল ও চিনির চাহিদা ও সরবরাহব্যবস্থার কথা তুলে ধরে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে চিনি ও ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে স্থানীয় আখ থেকে চিনি উৎপাদন করা হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে সরিষা ও অন্যান্য তেলবীজ থেকে প্রায় দুই লাখ টন ভোজ্য তেল উৎপাদিত হয়। পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের জন্য ২০ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়। এর পাশাপাশি ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টন পরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি করা অপরিশোধিত চিনির স্থানীয় পরিশোধনক্ষমতা আছে প্রায় ৩৫ লাখ টন। আর অপরিশোধিত সয়াবিন, পাম ও রাইসব্রান মিলিয়ে দেশে ভোজ্য তেলের উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৫৮ লাখ টন।
চিনির মজুদ
দেশের বিভিন্ন চিনি পরিশোধনকারী মিলে এক লাখ ৫৪ হাজার টন চিনি মজুদ আছে। অপরিশোধিত চিনির মজুদ ও আমদানির অপেক্ষায় থাকা মিলিয়ে চিনি রয়েছে মোট দুই লাখ ২১ হাজার টন। এতে আড়াই মাসের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
ভোজ্য তেলের মজুদ
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান মজুদ ও পাইপলাইন বিবেচনায় ভোজ্য তেল সরবরাহে কোনো সমস্যা নেই। প্রায় পাঁচ লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের মজুদ আছে। ২.৩০ লাখ টন আছে সরবরাহ লাইনে। সয়াবিন বীজের স্থানীয় মজুদ প্রায় ২.৩৬ লাখ টন। এই বীজ থেকে ৪০ হাজার টন সয়াবিন তেল পাওয়া যাবে। স্থানীয় মজুদ ও পাইপলাইন বিবেচনায় চার মাসের বেশি দেশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
চাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজের মজুদ
দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে চাল উৎপাদিত হয় ৩৯৪.৮১ লাখ টন। আমদানি করা হয়েছে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২২) ৩.১৯ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন, আমদানিসহ মোট সরবরাহ হয়েছে ৩৯৮ লাখ টন। গমের বার্ষিক চাহিদা ৭৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় ১২.২৬ লাখ টন। আমদানি করা হয়েছে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২২) ৩৩ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন, আমদানিসহ মোট সরবরাহ ৪৪.৭৫ লাখ টন।
মসুর ডালের বার্ষিক চাহিদা পাঁচ লাখ টন। দেশে উৎপাদন করা হয় ১.৮৬ লাখ টন। আমদানি করা হয়েছে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২২) ২.৯৬ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন, আমদানিসহ মোট সরবরাহ ৪.৮২ লাখ টন।
পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদন করা হয় ২৭.৩ লাখ টন। আমদানি করা হয়েছে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২২) ৪.৯৬ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন, আমদানিসহ মোট সরবরাহ ৩১.৫৩ লাখ টন।
উল্লেখ্য, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ শতাংশ এবং মসুর ডালের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হারে প্রক্রিয়াকরণ ক্ষতি দেখিয়ে মোট উৎপাদন দেখানো হয়।