আগামী দিনগুলোতে দেশের অর্থনীতিতে নানা সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। এক বছরের মধ্যে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে এসেছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের বোঝা বাড়ছে। আবার বিদেশি ঋণ সহায়তা কমছে। ইতিমধ্যেই চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩০.৩৮ শতাংশ কম ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশ দ্রুত বাড়ছে। এতে চাপ বাড়ছে ডলারের উপর। বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতের অনিয়ন্ত্রিত ঋণ গ্রহণ। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ধারা নেতিবাচক।
বিজ্ঞাপন
ফলে ডলার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের রিজার্ভের প্রধান সংকট মোটেও ইউক্রেন যুদ্ধ বা জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির জন্য নয়। মূলত ২০২১ সালের ঋণের অপরিশোধিত ৩০% হিসাব করে ২০২২ সালে মোট ২৩ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশকে সরকারি-বেসরকরি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এটাই রিজার্ভ সংকটের অন্যতম কারণ। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য রিজার্ভ যাতে কোনোভাবে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামে। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে মাসিক গড় আমদানি ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। এটিতে তারা এখন ৬ বিলিয়নে নিয়ে এসেছে। এমনকি ৪ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এটি করতে হলে খাবার, জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। তখন লোডশেডিং আরও বৃদ্ধি পাবে। শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাবে। আমদানি কমবে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে।
ফলে চাহিদা কমানোর কারণে একটা অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো- এর মধ্যে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় রিজার্ভে যোগ হবে। বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে: বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দুই বছরে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাড়ছে তুলনামূলক ধীরগতিতে। তবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের চাপে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ে করা এক পর্যবেক্ষণে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নিয়ে এক পূর্বাভাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১.৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
২০২২ সাল শেষে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ঠেকবে ২৩.৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়েও প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৮৬ কোটি বা প্রায় ৯৬ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের প্রায় ৭৩ শতাংশ নিয়েছে সরকার। বাকি ২৭ শতাংশ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। অন্যদিকে ২০২০ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮.৭৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের জুন শেষে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭.৭৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই বছরে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৯.০৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর স্বল্পমেয়াদি বেসরকারি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। ওদিকে গত এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ১০.৩৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬.৩৯ বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের জুন শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬.০১ বিলিয়ন ডলার। তবে সমপ্রতি রিজার্ভ আরও কমে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে চলেছে। আর রিজার্ভ থেকে ইডিএফ ফান্ডের আওতায় প্রদত্ত ঋণ বাদ দিলে তা দাঁড়াবে ২৮ বিলিয়ন ডলার। এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদি বেসরকারি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ঝুঁকি বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। আগামী মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের উপরে আকু পেমেন্ট দিতে হবে। তখন রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে চলে আসবে। প্রতি মাসে রিজার্ভ থেকে ২.৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়। সেটার পাশাপাশি ইডিএফ ও আইডিএফ তহবিলসহ অন্যান্য খাতে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে, তা যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে রিজার্ভ ২২ থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সরকারকে চাপমুক্ত হতে বেগ পেতে হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দুই-এক মাসের মধ্যে যদি আমরা আইএমএফের ঋণটা পেয়ে যাই, তাহলে কিন্তু আমাদের সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। রিজার্ভ কমার যে ধারা রয়েছে, সেটা আর থাকবে না। আর এই মুহূর্তে বড় বিষয় হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং রিজার্ভ কমতে না দেয়া। আর রিজার্ভ ধরে রাখতে হলে জরুরিভিত্তিতে আইএমএফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী ছয়-সাত মাসের মধ্যে একটা চাপ আসতে পারে। তখন এসব ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এটা থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায় তা হলো ঋণগুলো নবায়ন করা। না হলে সবগুলো একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। তখন বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে একটা চাপ তৈরি হবে। সে চাপ মোকাবিলায় রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগে থেকেই কন্ট্রোল করা উচিত ছিল। ম্যাক্রো ইকোনমিক পলিসির ভুলের কারণে এখন ভুগতে হচ্ছে। এ ছাড়া এখন তো সুদের হারও বেড়ে গেছে। এদিকে দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বায়ার্স ক্রেডিট (সরবরাহকারীর ঋণ)। ২০২০ সালের জুনে বায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ ছিল চার দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার ও ২০২২ সালের জুনে দাঁড়িয়েছে ৯.৭৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দুই বছরে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে ৫.১০ বিলিয়ন ডলার বা ১০৯ শতাংশ। বায়ার্স ক্রেডিট ঋণ হলো- দেশের কোনো আমদানিকারক বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেন, যা এক বছরের মধ্যে শোধ করতে হয়।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্যবসায়ীদের এই ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। এদিকে সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দুুটিরই পতন হয়েছে। ২০২২-২৩ সেপ্টেম্বর রপ্তানি হয়েছে ৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। একই মাসে এই বছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১.৫৪ বিলিয়ন ডলার। বিদেশি ঋণ সহায়তা কমলো: অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৩ মাসে ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা। অথচ এর আগে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রতিনিয়তই মুদ্রাবাজারের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই সতর্ক।