আমন মৌসুমের শুরুতে গত আগস্টে হঠাৎ করেই ইউরিয়া সার এবং ডিজেলসহ সব জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। বাড়তি খরচের বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষক ধান রোপণের প্রস্তুতি নেন। তখনই শুরু হয় প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। ভরা বর্ষায়ও খরায় পুড়তে থাকে বীজতলা। লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হয় সেচ ব্যবস্থাও। শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ফলে কিছুটা স্বস্তি মেলে। এর কয়েকদিন পরই সপ্তাহখানেক চলে বৃষ্টি। কষ্টে ফলানো কৃষকের সেই সোনালি ধান আর ২০-২৫ দিন পরই ঘরে তোলার কথা। কিন্তু গত সপ্তাহে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ধূলিসাৎ করে দিয়েছে চাষির স্বপ্ন। সিত্রাং যে পথ দিয়ে গেছে সেখানে রেখে গেছে তার ক্ষত চিহ্ন। কৃষকের স্বপ্ন কোথাও নুয়ে পড়েছে, আবার কোথাও চলে গেছে পানির নিচে। দেশে খাদ্য সংকটের শঙ্কার মাঝে এমন বিপর্যয় বিপদ আরও বাড়িয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হচ্ছে বোরো ও রবি মৌসুম। দেশে খাদ্যশস্য সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় এ মৌসুমেই। সারসহ চাষাবাদে প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদাও থাকে বেশি। বীজ, সারসহ সব কৃষি উপকরণের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। ফলে আমনের ক্ষতি কাটিয়ে বাড়তি খরচে বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমন ও বোরোর উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা শঙ্কায় পড়বে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দ্রুত প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়া জরুরি।
আমনে সিত্রাংয়ের আঘাত: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাথমিক তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের আঁচ লেগেছে দেশের ৩১টি জেলার কৃষিতে। এসব জেলার ৫৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খুলনায় ১১ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমির ফসল। তবে সমকালের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য মতে, দুই লাখ হেক্টর কৃষিজমি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, আমন মৌসুমে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জিত হয়। এ বছর আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ লাখ হেক্টর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক হাবিবুর রহমান চৌধুরী সমকালকে জানান, সব মিলিয়ে মোট আবাদের ২ শতাংশের মতো আমন ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই হিসাব চূড়ান্ত হবে।
সরেজমিন উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী মোট আবাদের ২ শতাংশ আমন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৭৬০ হেক্টর।
কমবে বোরো উৎপাদন, চালের বাজারে প্রভাব: দুই সপ্তাহের মধ্যে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হবে। সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক ব্যবহারের ৭০ শতাংশেরও বেশি হয় শুধু বোরো মৌসুমে। একইভাবে সেচের ব্যবহার লাগে বেশি। কিন্তু সেচযন্ত্রের প্রধান জ্বালানি ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়বে উৎপাদন খরচ। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) তথ্য ধরে হিসাব করলে ডিজেলের দাম বাড়ায় শুধু সেচের জন্য বোরোতে কৃষকের খরচ বাড়বে প্রায় দুই হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এরসঙ্গে সার, বীজসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ার বোঝাতো আছেই। ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয় কেজিপ্রতি ছয় টাকা ও চলতি মাস থেকে সব ধরনের বীজের দাম বেড়েছে ২০-৩০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত কৃষি উপকরণের দাম বহাল থাকলে তা ধানের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। এর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে আসবে আগামী বছরের মার্চ নাগাদ। কারণ তখন বোরো ধানের চাল বাজারে আসবে।
এদিকে বোরো মৌসুমে রয়েছে সার সংকটেরও শঙ্কা। কারণ রাসায়নিক সারের চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক চাহিদা ৬০ লাখ টনের বেশি। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুত আছে ৬ লাখ ৪১ হাজার টন।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ৬০ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে। এটি পুরোটাই সেচনির্ভর। সব মিলে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি আছে, যার ৭৫ শতাংশই ডিজেলচালিত। ফলে ডিজেলসহ সব উপকরণের দাম কমানো দরকার।
পূর্বাভাসে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা: চলতি বছর ধান উৎপাদন কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) চলতি মাসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের ধান, গম ও অন্যান্য দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমবে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কমবে ধানের উৎপাদন।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সূত্রমতে, ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে মোট ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে। গত বছরের তুলনায় প্রায় দুই লাখ টন চাল কম উৎপাদন হতে পারে।
চলতি বছরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৯ লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এজন্য চালের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিতে আমদানিতে শুল্ক্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পরও গত চার মাসে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ চাল আমদানি হয়নি। মূলত ভারতে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকা ও ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতাকে এক্ষেত্রে কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ১ জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্তত বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭০ টন। আর সরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে সাড়ে ২৩ হাজার টন।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, এ মুহূর্তে সবজির চারা, বীজ, সারসহ অন্যান্য উপকরণ কৃষককে বিনামূল্যে দিতে হবে। বোরো মৌসুমেও সব রকম সহায়তা দিতে হবে। কারণ কৃষকরা এ ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি সব হারিয়েছেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, প্রয়োজনে অন্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে হলেও কৃষিতে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। না হলে খাদ্য নিরাপত্তা বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, উৎপাদন বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছি। বোরো মৌসুমের ব্রি-২৮, ব্রি-২৯সহ আমন ও আউশ চাষের প্রচলিত জাতগুলোর প্রতিস্থাপন করে উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের চাষ বাড়িয়ে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন প্রায় ৩২ লাখ টন বাড়ানো সম্ভব। তিনি আরও বলেন, রবি মৌসুমে আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ১৩৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সারে ভর্তুকি পাচ্ছেন কৃষক।