গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের অসুস্থ বাছিরন বেগম (৫৬) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জ থানা মোড় থেকে গতকাল শুক্রবার সকালে ওই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য বের হলেও কোনো বাস পাচ্ছিলেন না। আরেক রোগী নুরুল ইসলামও বাস না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অন্যদিকে, পঞ্চগড় জেলা শহরের ধাক্কামারা এলাকার বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশের পান দোকানদার ফজলুর রহমানের কষ্টটা আরও বেদনাদায়ক। এই দোকান চালিয়েই তাঁর পাঁচজনের সংসার চলে টেনেটুনে। গাড়ি বন্ধ থাকায় তাঁর বেচাবিক্রিও একদম বন্ধ। তিনি বলেন, ‘গাড়ি না চললে হামার পেটও চলিবা নাহায়। বিআরটিসির লোকরাই হামার কাস্টমার। সকাল থেকে বসে আছু।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি করি। আজকে কোনো বেচাবিক্রি নেই।’
ফজলুর রহমানের মতো অর্থকষ্টে পড়েছেন পঞ্চগড় বিআরটিসি বাস ডিপোর শ্রমিকরাও। অন্যদিকে, হঠাৎ বাস বন্ধ হওয়ায় দৈনিক মজুরিতে কর্মরত শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। অনেকের বাড়িতে চুলা জ্বালানোর মতো অবস্থা নেই বলেও মন্তব্য করেছেন বেশ কিছু মোটর শ্রমিক। রংপুর রুটের গাড়িতে কর্মরত হায়দার আলী নামে এক বাস শ্রমিক বলেন, এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বেশি। কিনতে হিমশিম খেতে হয়। কাজ করি, দিন আনি, দিন খাই। কিন্তু বাস বন্ধ থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
দৃশ্যত বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ বানচাল করতে ডাকা রংপুর বিভাগের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে পঞ্চগড়-রংপুর রুট হয়ে বগুড়া, রাজশাহীসহ সব রুটে বিআরটিসি বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। সাধারণত পঞ্চগড়, রংপুর হয়ে বিভিন্ন রুটে ৩০ থেকে ৩২টি বিআরটিসি বাস নিয়মিত চলাচল করে। তবে গতকাল সকাল থেকে বিআরটিসির কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। বগুড়া-ঢাকাগামী বিআরটিসি বাস ছাড়া অন্য যাত্রীবাহী বাস দিনাজপুর-ফুলবাড়ী হয়ে বগুড়া-ঢাকা রুটে চলাচল করছে। এতে রংপুর এবং আশপাশের এলাকার বিআরটিসির যাত্রী, শ্রমিকসহ সংশ্নিষ্টরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
পরিবহন ধর্মঘটে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন রোগীরা। হঠাৎ করেই রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতি শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ৩৬ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে। সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে বগুড়া ও রাজশাহী বাস মালিক সমিতি। ফলে রংপুর বিভাগে দূরপাল্লার বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন শুক্রবার ভোর থেকেই চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে উত্তরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। অটোরিকশা ও মাহিন্দ্রাই ছিল একমাত্র চলাচলের বাহন। এতে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের।
পঞ্চগড়ে আফতাব হ্যাচারিতে কর্মরত রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকার হানিফ মিয়া জানান, শুক্রবার ছুটি পেয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য বিআরটিসির বাস কাউন্টারে এসে জানতে পারেন বাস চলাচল বন্ধ। তিনি বিআরটিসির গাড়িতেই নিয়মিত যাতায়াত করেন। এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
পঞ্চগড়-রংপুর বিআরটিসি বাসের সুপারভাইজার মো. মিন্টু বলেন, রংপুরে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে শুক্রবার পঞ্চগড় থেকে কোনো বিআরটিসি বাস ছেড়ে যায়নি। তাঁরাও সকাল থেকে বসে আছেন। তবে পঞ্চগড় মোটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আকবর আলী বলেন, সকালে পঞ্চগড়-দিনাজপুর হয়ে দূরপাল্লার বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাস ছেড়ে গেছে। এ ছাড়া তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা থেকে দিনাজপুরসহ আন্তঃজেলার সব কটি রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের মিঠাপুকুরে কমলা বেওয়া বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন বাসের জন্য। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে তিনি যেতে পারছিলেন না। তাঁর এক স্বজন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওষুধ-পথ্য নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত দুপুরের দিকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চেপে বসেন। তাঁর মতো আবদুল খালেক, রবিউল ইসলামসহ অনেকে ধর্মঘটের কবলে পড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে নাকানিচুবানি খেয়েছেন। মিঠাপুকুরে গতকাল দিনভর এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে।
টমাস নামে আরেক যাত্রী রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বাস না পেয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েন। বলেন, ‘ভাই, আমার বড় ভাই ঢাকায় থাকেন। জরুরি কাজে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আজই যেতে হবে। কিন্তু এখন কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
বাগানের অনেকগুলো কলা নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলেন ব্যবসায়ী রতন মিয়া। তিনিও আটকা পড়েন। সময়মতো যেতে না পারলে কলাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। দুঃখ করে বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। ওমারগুলার জেদাজেদির কারণে আইজ হামার এই অবস্থা। কলাগুলা পচি গেইলে বড় সর্বনাশ হইবে। বউ ছইলগুলাক কী খিলামো?’
আজ শনিবার দুপুরে রংপুরের কালেক্টরেট মাঠে বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে বিএনপি। দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশের আগে ডাকা ধর্মঘটের সঙ্গে এর মিল দেখছেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলছেন, এটা পরিকল্পিত। সরকারের ইশারায় বাস মালিকরা অন্যায়ভাবে ধর্মঘট ডাকছেন। এতে জনসাধারণের চলাচলেও মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম রাব্বানী বলেন, বাস মালিক সমিতি ইচ্ছা করে এই ধর্মঘট ডেকেছে। এটা কখনোই শোভন নয়। বিএনপির মহাসমাবেশ বানচাল করার জন্যই ক্ষমতাসীন দলের ইশারায় আকস্মিকভাবে বাস ধর্মঘট ডেকেছে মালিক সমিতি।
গাইবান্ধা বাস টার্মিনালে আসা যাত্রী রহমতউন্নবী সরদার জানান, শুক্রবার বিকেলে তাঁর স্ত্রীকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়াল পেয়েছেন তিনি। কিন্তু ফজরের সময় বাড়ি থেকে বের হয়ে নৌকায় যমুনা নদী পার হওয়ার পর অটোরিকশায় গাইবান্ধা বাস টার্মিনালে আসেন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। কিন্তু রংপুরের বাস চলাচল বন্ধ থাকায় তিনি গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে বিপাকে পড়েন। দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর তিনি বাধ্য হয়েই বাড়ি ফিরে যান।
সুন্দরগঞ্জ থেকে নীলফামারীর উদ্দেশে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর থেকে সন্তানসন্ততি নিয়ে রওনা দেওয়া আছিয়া বেগম বলেন, জেলার ডিমলায় তিনি শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাস না পেয়ে পরে গাইবান্ধা বাস টার্মিনাল থেকে তিনি ফের বাবার বাড়ি ফেরত যান। আগে থেকে ধর্মঘট জানলে টাকা খরচ করে গাইবান্ধায় আসতেন না।
রংপুর সদর উপজেলার পাগলাপীর থেকে রাজধানীতে যাওয়ার জন্য আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রবিউল আলম। শনিবার তাঁর ল্যাব ফাইনাল পরীক্ষা। বাস বন্ধ শুনে বিপাকে পড়েছেন তিনিও। তাঁদের মতোই রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ থেকে মেয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে এসেছেন সুফল রায়। বাস বন্ধের খবর শুনে বাধ্য হচ্ছেন ফিরে যেতে।
এদিকে একই ধরনের দুর্ভোগে পড়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীরা। দূরদূরান্ত থেকে রিকশা-ভ্যানে করে আসছেন তাঁরা। শুক্রবার দুপুরে মেডিকেল চত্বরে কথা হয় বৃদ্ধা হালিমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি এসেছেন হারাগাছ থেকে। জানালেন, তাঁর ছেলে অসুস্থ। সকাল থেকে অপেক্ষা করার পরও গাড়ি না পেয়ে বাড়তি ভাড়া দিয়ে ভ্যানে করে এসেছেন।
ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত মানেনি দিনাজপুর মালিক সমিতি: রংপুর বিভাগীয় পরিবহন ধর্মঘট চললেও দিনাজপুরে নেই পরিবহন ধর্মঘট। তবে জেলা থেকে যেসব বাস চলাচল করছে, তা রংপুর পর্যন্ত যাচ্ছে না, যাচ্ছে সৈয়দপুর পর্যন্ত। তাছাড়া আগাম পরিবহন ধর্মঘটের খবর ছড়িয়ে পড়ায় যাত্রী উপস্থিতিও অনেকাংশে কম। উপস্থিতি কম হওয়ায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন পরিবহন সংশ্নিষ্টরা। আর মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, রংপুর থেকে যে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, তা দিনাজপুরের সঙ্গে কথা না বলেই করা হয়েছে।
দিনাজপুর মোটর পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাহেদ রিয়াজ চৌধুরী পিম বলেন, রংপুর থেকে যে বিভাগীয় ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, তা আমাদের সঙ্গে কথা না বলেই করা হয়েছে। রংপুর মালিক সমিতি নিজেদের মতো পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ধর্মঘটের সঙ্গে দিনাজপুরের মালিক সমিতির কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। তাই আমরা যথারীতি পরিবহন চালিয়ে যাচ্ছি। দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও গাইবান্ধা রুটে পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
দিনাজপুরের মির্জাপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, দিনাজপুর থেকে বাস, ট্রাকসহ যাবতীয় পরিবহন যথানিয়মেই চলাচল করছে। এসব বাস রংপুর পর্যন্ত না গিয়ে সৈয়দপুর পর্যন্ত যাচ্ছে। এদিকে দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড়, দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর থেকে গাইবান্ধা জেলায়ও বাস চলাচল করছে। দিনাজপুরের অভ্যন্তরীণ রুটেও সব ধরনের পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
তবে দিনাজপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত বাস চলাচল করছে না, করছে সৈয়দপুর পর্যন্ত। আর অন্য সব রুটের বাস চলাচল যথানিয়মেই শিডিউল মেনেই চলাচল করছে। রংপুরগামী যাত্রী সাজেদুর রহমান বলেন, ‘আমি রংপুর পর্যন্ত যাব, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে সৈয়দপুর পর্যন্ত। এর পর আমি কীভাবে যাব বুঝতে পারছি না। আমাদের তো অনেক কাজ রয়েছে, যাত্রীদের জিম্মি করে এই পরিবহন ধর্মঘট ঠিক নয়। জরুরি কাজে আমাকে রংপুরে যেতে হবে।’
এদিকে রংপুরে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গতকাল সকাল থেকে পঞ্চগড়-রংপুর রুটে বিআরটিসি বাস বন্ধ থাকলেও পঞ্চগড় থেকে দশ মাইল এলাকা হয়ে পঞ্চগড়-দিনাজপুর রুটে গেটলক বাসসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। আন্তঃজেলার ছয়টি রুটেও বাস-মিনিবাসসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে।