সারা দেশে ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। রোগী বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যু। গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজন মারা গেছে ডেঙ্গুতে। এ নিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত ১২৮ জনের মৃত্যু হলো এ রোগে।
বিজ্ঞাপন
এর মধ্যে ঢাকায় মারা গেছে ৭৩ জন। চলতি মাসে এ পর্যন্ত ঢাকায় মারা গেছে ৪৬ জন।
গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে ডেঙ্গুর সর্বশেষ এই তথ্য জানা যায়। তারা বলছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরো ৪৪০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৌর শহরগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির কারণ। ডেঙ্গু এখন ঢাকার বাইরে স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভয়াবহতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ১০ গুণ খারাপ হতে পারে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। চাপ বাড়ছে জেলার হাসপাতালগুলোতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শুধু চলতি অক্টোবরে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সাত হাজার ৭৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ২৭ জন।
নতুন রোগীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি তিন হাজার ৫৩৯ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি দুই হাজার ২৮০ জন। ঢাকার বাইরে এক হাজার ২৫৯ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৬৯, খুলনা বিভাগে ১৮১, রাজশাহী বিভাগে ১৫৫, বরিশালে ১৮১ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৭৫ জন ভর্তি। এ ছাড়া রংপুর বিভাগে ১৫ জন ও সিলেটে ১২ জন ভর্তি হয়। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৩৫ হাজার ২৬২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু বিস্তারের প্রথম কারণ গত ২২ বছরে ঢাকায় রোগটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। যেহেতু বাস-ট্রাক, ট্রেন-লঞ্চ ইত্যাদির মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ অনেক বেশি, ফলে ঢাকা থেকে মশা বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারে। বলা যায়, স্থানীয়ভাবে এখন সংক্রমণ হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যদি ধরি দুই কোটি মানুষ। এখানে রোগ শনাক্ত, এডিস মশা প্রতিরোধ, রোগীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে ছোট শহরগুলোতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেশি হচ্ছে। আমরা দুই কোটি মানুষ নিয়ে যদি হাবুডুবু খাই, ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে যদি সংক্রমণ হতে থাকে তাহলে ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বা ২০১৯ সালে ডেঙ্গু নিয়ে যে হাবুডুবু খেয়েছি, এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ’
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাড়ে তিন শতাধিক পৌরসভায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। নগরায়ণ হলে এডিস মশা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মশক নিধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও অর্থ কোনোটাই নেই।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ঝড় ও বৃষ্টিপাতের কারণে গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ সার দেশে মশা কমেছে। ঝড়বৃষ্টি যখন হয়, তখন বাইরে থাকা উড়ন্ত মশার ডানা ভেঙে যায় এবং ৮০ শতাংশ মশা মারা যায়। আবার লার্ভার জন্মস্থলগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। এতে কয়েক দিন ধরে মশা কম। তাই বলে যে ডেঙ্গু রোগী কমে যাবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ডেঙ্গু হয় মশা কামড়ানোর চার থেকে সাত দিন পর।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ঝড়ে ঘরের ভেতরে থাকা মশা কিন্তু মরেনি। সেগুলো আবার প্রজনন স্থান তৈরি করবে বৃষ্টির পানি জমে থাকা বিভিন্ন পাত্রে। তাই বিভিন্ন জায়গায় যে নতুন করে পানি জমল, সেই জমা পানি যদি আমরা সঠিকভাবে অপসারণ করতে না পারি, বিপদ আসন্ন। দেখা যাবে আগামী ১৫ দিন পরে মশা আবার বাড়বে। ’
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এডিস মশা কামড়ানোর দুই থেকে সাত দিন পর উপসর্গ স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়। লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। অনেকে মনে করে, হালকা জ্বর কোনো ক্ষতি করবে না। এই চিন্তা বাদ দিতে হবে।
তিনি বলেন, ৫ শতাংশের কম ক্ষেত্রে এ ধরনের ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ঘটে। যাদের আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্যান্য স্টেরিওটাইপের সংক্রমণ ঘটেছে, তাদের ঝুঁকি বেশি। এ বছর বেশির ভাগ মানুষ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে, ফলে ডেঙ্গু রোগীর সিভিয়ারিটি বাড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধদের ঝুঁকি বেশি। তাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। খালি গায়ে না থাকা। দিনে ঘুমালে বা যখনই ঘুমায় মশারির মধ্যে ঘুমানো উচিত। আর বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খাওয়া। মনে রাখতে হবে, তরল খাবারে ডেঙ্গুর সিভিয়ারিটি অনেক কমে।