সরকার বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় অর্থ সঙ্কটে পড়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। তারা এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর মতো জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। আগে যেখানে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করত এ বেসরকারি কেন্দ্রগুলো, এখন তা ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে সামনে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকার কোনো কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও আইনত বাধ্যবাধকতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। বিল পরিশোধ না করার কারণে কেন্দ্রেগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিলে একদিকে জনদুর্ভোগ বাড়বে, কমে যাবে শিল্প উৎপাদন, পাশাপাশি বেড়ে যাবে ক্যাপাসিটি চার্জ।
পিডিবির হিসেবে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট। যদিও বাস্তবে এরও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে খোদ রাজধানীতে। দিনে রাতে ৫ থেকে ৬ বার লোডশেডিং করা হচ্ছে। এতে বেড়ে গেছে জনদুর্ভোগ। পাশাপাশি শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প মালিকরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা চাচ্ছেন। কিন্তু ডলারের সঙ্কটের কারণে কাক্সিক্ষত হারে জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। এ কারণে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা জানিয়েছেন, গত মে মাসের পর থেকে তারা কোনো বিল পাচ্ছেন না। বর্তমানে তাদের বকেয়া বিলের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানির মূল্য, সরকার কেনা বিদ্যুৎ ও ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বকেয়া বিল না পাওয়ায় এক দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না, অপর দিকে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের কাছে বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ সরকারের সাথে তাদের করা চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, সরকার ৪৫ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধ করবে। কিন্তু বতর্মানে প্রায় ৫ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় তাদের জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তার ৫০ শতাংশ উৎপাদন করছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো। আগে যেখানে উৎপাদন করা হতো ৫৫ শতাংশ। বকেয়া বিল পরিশোধ করা না হলে সামনে এ হার আরো কমে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। তিনি জানান, অপরিশোধিত বিলের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট ও মাঝারি আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কারণ ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংকিং লাইন শেষ হয়ে গেছে এবং তারা আর ক্রেডিট লাইন খুলতে পারবে না। এমনকি যদি সরকার এখন অর্থ প্রদানের বিষয়টির নিষ্পত্তিও করে, তবে তা বর্তমান বিনিময় হারের (ডলার) প্রতিফলন ঘটাবে না, তাই ঘাটতি দেখা দেবে। তিনি বলেন, পিডিবির কাছ থেকে প্রতি ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা হিসেবে বিল পাচ্ছেন। কিন্তু বর্তমানে প্রতি ডলার কিনতে ১০৫ টাকা খরচ হচ্ছে। শুধু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রতি ডলারে লোকসান হচ্ছে ২০ টাকা। এ পর্যন্ত তাদের মুদ্রার বিনিময়জনিত ক্ষতি হয়েছে চার হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে আমরা সরকারের কাছে তিন হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসাররা (আইপিপি) নিজেরাই ভারী জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। অর্থ প্রদানে বিলম্বের আশঙ্কায় তারা আমদানি বিলের ওপর সরকারের কাছ থেকে ৩ শতাংশ সুদ আদায় করে থাকে। কিন্তু তাও এখন আর যথেষ্ট নয়। তারা জানিয়েছেন, পাঁচ মাস ধরে তারা বেতন দিতে পারছেন না। যদিও দীর্ঘমেয়াদি বেসরকারি বিদ্যুকেন্দ্রগুলো (যাদের মুনাফা-হার উচ্চ নয়) সরকারের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট ছাড় পেতে পারে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চলাভের হারে পরিচালিত স্বল্পমেয়াদি ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অপরিশোধিত বিলের কারণে সাধারণ জনগণ ভুক্তভোগী হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- পিডিবির সদস্য (অর্থায়ন) এস কে আক্তার হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাদের বিল পরিশোধ করতে হয় না। বিল পরিশোধের বিষয়ে অভিন্ন কোনো চুক্তি নেই। বিভিন্ন কোম্পানির সাথে বিভিন্ন চুক্তি আছে। কোনো কোনো কোম্পানির সাথে ৬০ দিন পর্যন্ত চুক্তি আছে। তিনি বলেন, মে মাসের বিল শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি চুক্তি অনুযায়ী তাদের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে।
সোর্স : নয়া দিগন্ত