ডলার সঙ্কট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে খাদ্যসহ কিছু নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট দুই মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চাল আমদানি সাড়ে ৬৭ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে গম আমদানি কমেছে ২৩ শতাংশ। সার্বিক খাদ্যশস্য আমদানি কমেছে ৩৮ শতাংশের মতো। নতুন এলসি স্থাপন আমদানি নিষ্পত্তির তুলনায় আরো বেশি হারে কমছে। এর ফলে ভবিষ্যতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্র অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে এলসি নিষ্পত্তি যেখানে সাড়ে ৩১ শতাংশ বেড়েছে সেখানে নতুন এলসি কমেছে সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি। খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে নতুন এলসি হ্রাসের হার আরো বেশি বলে জানা গেছে। অন্য দিকে আমদানিকারক সূত্র জানিয়েছে, ডলারের মূল্যের অস্থিরতা এবং এলসির জন্য ডলার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের একজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, তিনি খাদ্য আমদানির জন্য যখন এলসি করেছিলেন, তার তুলনায় এলসি নিষ্পত্তির সময় ডলারের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এতে বর্তমান বাজার দরের চেয়েও আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাকে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের অনেক খাদ্য আমদানিকারক চাল-গম আমদানি থেকে বিরত রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে চাল-গমের পাশাপাশি ডাল ও চিনির আমদানিও কমে গেছে। এই সময়ে ডাল আমদানি কমেছে ১৭ শতাংশ আর চিনি আমদানি কমেছে সাড়ে ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে উভয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাজারে বেড়ে গেছে। এ সময়ে দুধ ও শিশুখাদ্যের আমদানিও সাড়ে ১৩ শতাংশের মতো কমেছে। বাজারে শিশুখাদ্যের দামও দফায় দফায় বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি হ্রাসের যে তথ্য তা মূল্যভিত্তিতে করায় পরিমাণের হিসাবে আমদানি কমার হার আরো বেশি হবে বলে জানা গেছে। চাল গম চিনি ডালের দাম বিশ্ববাজারে এক বছরের আগের তুলনায় এখন বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে যুক্ত হবে টাকার অবমূল্যায়নের হার।
আমদানিকারকরা বলছেন, যেসব ভোগ্যপণ্যের ব্যাপারে বিদেশনির্ভরতা বেশি সেগুলো আমদানির বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া না হলে খুব দ্রুতই এসবের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা আরো চাঙ্গা হবে। গমের ক্ষেত্রে দেশের চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে মেটাতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়ে গেছে। আর গত কয়েক মাসে টাকার বড় আকারের অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় মুদ্রায় আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
চালের ক্ষেত্রে সরকার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করে আসছিল। এরপরও প্রতিবছরই বেসরকারি খাত চাল আমদানি করে এসেছে। এবার আবহাওয়াগত কারণে ফসল উৎপাদন কম হওয়ায় চালের আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে। সরকার এ কারণে চাল আমদানির উপর বিধিনিষেধ কমিয়েছে। কিন্তু এর পরও দেশের ভেতরের চাহিদা অনুসারে চাল আমদানি হচ্ছে না। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের বাজারে এমনিতে চালের যে উচ্চমূল্য দেখা দিয়েছে তা আরো ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।
নিত্যভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে ভোজ্যতেলের আমদানি এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য ভোজ্যতেল আমদানি বাড়লেও একই সময়ে তেলবীজ আমদানি ১২৬ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় নতুন এলসি স্থাপনের হার একেবারেই কমে গেছে। অনেকে ডলারের অভাবে শতভাগ মার্জিন দিয়েও ব্যাংকে এলসি স্থাপন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে নতুন এলসি ৮.৫৭ শতাংশ কমে ১৮.৫৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি ৩১.৫৬ শতাংশ বেড়ে ২২.৪৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমদানি নিষ্পত্তি যেখানে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হচ্ছে সেখানে নতুন এলসি হচ্ছে প্রতি মাসে গড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। যতই দিন যচ্ছে এলসি স্থাপন ও নিষ্পত্তি দুটিই কমছে।
জানা গেছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে সরকার ডলার সাশ্রয়ে সফল হলেও এতে পণ্য সরবরাহে ঘাটতিও সৃষ্টি হচ্ছে। পুরনো মজুদ ফুরিয়ে আসার সাথে সাথে এসব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কা ব্যক্ত করে ভোগ কম ও সঞ্চয় বৃদ্ধির আহ্বান জানানোর প্রভাবও বাজারে দেখা যাচ্ছে। এতে এমন একটি আবহ তৈরি হয়েছে যে সামনে টাকা দিয়েও যেন ভোগ্যপণ্য মিলবে না।
এ অবস্থা পরিকল্পিতভাবে নীতি বিন্যাস না করা হলে অর্থনীতিতে এবং সামাজিকভাবে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে অনেক পর্যবেক্ষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।