ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্য পরিবর্তন করতে। কিন্তু ভাগ্যবদল দূরের কথা, এখন তাকে তিনবেলার জায়গায় দুইবেলা কখনো একবেলা খাওয়ার অভ্যাস করতে হচ্ছে। মাথা থেকে ডালা নামিয়ে শফিকুল কথাগুলো বলে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনারাই বলেন কীভাবে কি করি? হিসাব যে মেলে না। দু-একবেলা নাই বা খেলাম। কী আর হবে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাসিন্দা শফিফুল ইসলাম গাজীপুরের কাশিমপুর আসেন পরিবার নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়েটা নার্সারিতে পড়ে। শফিকুল শুরুতে গাজীপুরে এক গার্মেন্টে কাজ করতেন। কিন্তু গত দু’বছর ধরে তার একার উপার্জনে আর চলছে না। সেখানে স্ত্রীকেও এক সোয়েটার কারখানায় কাজে দেন।
বুধবার কাওরান বাজারে দুপুরের উত্তাপ কম হলেও শফিকুল দরদাম করে ঘামছিলেন।
বিজ্ঞাপন
গামছা দিয়ে মুখটা মুছে বললেন, স্ত্রী’র ইনকামে বাসা ভাড়া দিতেই চলে যায়। ওদিকে আমিও আর ফুলটাইম কাজ করতে পারি না। সপ্তাহে যেদিন যেদিন ছুটি হয় চলে আসি কাওরান বাজারে। মিনতি শ্রমিকের কাজ করি। ডালায় করে লোকজনের বাজার সদাই টানি। কখনো হোটেলে, কখনো বসায় পৌঁছে দেই। কিছু আয় হলে আবার চলে যাই। কিন্তু এখন এই কাজেও তেমন সুবিধা করা যায় না। আগে অল্প কিছু বাজার করেই লোকজন মিনতি ডাকতো। এখন সবকিছুর খরচ এত বাড়ছে যে নিজের বাজার নিজেরাই চেষ্টা করে টেনে নেয়ার। তাছাড়া একজন বাজারকারীর পেছনে কয়েকজন মিনতি জড়ো হয়ে যায় । সবারইতো টাকা দরকার। তারাই বা করবে কি!
শফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ থেকে আরেক মিনতি শ্রমিক তাকে ডাক দেয়। আমাদের কথা বইলা কি আর লাভ আছে! তারচেয়ে ভালো চলো কাজ করি।
শফিকুল জিরিয়ে নিলেন একটু। জানালেন, সকাল ৭টায় কাশিমপুর থেকে কাওরান বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। কাওরান বাজার একদিন থাকেন। কাজ করেন রাত ১০-১১টা পর্যন্ত। কখনো বা সারারাত। কাওরান বাজারের একটি টিনশেডে থাকেন রাতে অন্য মিনতিদের সঙ্গে। ঘুমানোর জায়গা বাবদ ভাড়া দেন বিশ টাকা। ডালার ভাড়া ত্রিশ টাকা। পরদিন ফের তিনি ফিরে যান কাশিমপুর। ক’দিন পর আবার আসেন। আর এভাবে আসা-যাওয়ার ভাড়া, খাওয়া-থাকার খরচ সবমিলিয়ে তার দিন শেষে হাতে দু একশ’ টাকা থাকে। মাঝে মাঝে আবার বেশি রাত হলে ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়া লাগে।
কিন্তু এই সামান্য ক’টা টাকার জন্য আপনি ঢাকায় কেন আসেন? সব যদি খরচই হয়েই যায়!
বললেন- কী করবো, এক কাজ করে যে সংসার চালানো মুশকিল। কপাল ভালো হলে মিনতির কাজ করে পাঁচ/ছয়শ’ টাকাও আয় করতে পারি দিনে। কিন্তু সবদিন তো সমান যায় না। তাই মাঝে মাঝে একবেলা করে খাই। খালি হাতে তো আর বাসায় ফেরা যায় না। সকালের নাস্তা করাও বাদ দিছি অনেকদিন।
শফিকুল ইসলামের ছোট মেয়ের নার্সারিতে প্রতিমাসে বেতন দিতে হয় পনেরশ’ টাকা। বড্ড বেকায়দায় আছি- এমন মন্তব্য করে তিনি বললেন, কাওরান বাজার থেকে যেদিন কাশিমপুর যাই সময় পেলে ঝালমুড়ি বেচি রাতে সেখানে। মেয়েটার বেতন তো আর বাকি রাখা যায় না।
কিন্তু শরীরে কি কুলায় একসঙ্গে এত ধরনের কাজ করে? বললেন, উপায় নাই। আগে শুধু আমার স্ত্রী আর আমার আয়েই সব চলতো। এখন দিনরাত না ঘুমিয়ে কাজ করেও যা রোজগার করি তা দিয়ে পুরো মাস যায় না। চিকিৎসা করাই না অসুখ বিশুখে। তারপরও ধারদেনা করা লাগে।
শফিকুল ইসলাম পুরো কথা শেষ করতে পারলেন না। দৌড়ে ভিড়ের মধ্যে চলে গেলেন এক ক্রেতার বাজার টানার উদ্দেশ্যে।