মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় কবে নাগাদ এই পদ্ধতি শুরু হবে তার সুনির্দিষ্ট সময় বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে যা কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের নিয়মে হিসাব করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি দেখাচ্ছে এমন অভিযোগ তোলে আইএমএফ। ফলে রিজার্ভ কত? এ নিয়ে শুরু হয় নানা বিতর্ক। তবে এর অবসান হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধিদের বৈঠক আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী হিসাব পদ্ধতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে আইএমএফ এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহ আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের সঙ্গে রিজার্ভসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আমরা নীতিগতভাবে একমত। আগামীতে আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করেই রিজার্ভ হিসেবে হিসাবায়ন করা হবে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসেব হয় আইএমএফের ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম ৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী।
বৈঠকে আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে আলাদাভাবে বিভিন্ন তহবিল গঠন ও সেখান থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার ওইসব অর্থ রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। এতে রিজার্ভ বেশি দেখানো হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এভাবে রিজার্ভের হিসাব দেখানো ঠিক হচ্ছে না। আইএমএফ মনে করে এতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের চিত্র ফুটে উঠছে না। রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র আড়াল করায় বাংলাদেশেরই বরং ঝুঁকি বাড়ছে। আইএমএফের দৃষ্টিতে এই গরমিলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের স্বার্থেই এ হিসাব আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী করা উচিত। তারা আরও বলেছেন,ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ আইএমএফের সদস্য সব দেশই আইএমএফের প্রচলিত আন্তর্জাতিকমান মেনে রিজার্ভের হিসাব করে এবং তা প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রিজার্ভের হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফের মান মানছে না। নিজেদের মতো করে হিসাব করে বেশি রিজার্ভ দেখাচ্ছে। বৈঠকে আইএমএফ ডলারের একাধিক দর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটির মতে, ডলারের একটি ইউনিক দর থাকা উচিত। যেটি বাংলাদেশে নেই। এদিকে ঋণ ও আমানতে সুদহারে আরোপিত সীমাও প্রত্যাহার চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। ঋণের সুদহার এত কম রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মানদ-ে হিসেবের পরামর্শ দিচ্ছে আইএমএফ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের মতো করেই হিসাব করছে। সেই হিসাবে বর্তমানে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে যা কমে দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। এতো দিন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসাবটাই প্রকাশ করে আসছে। সেই হিসাবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন এবং শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) এর আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আগামীতে অনুষ্ঠেয় বৈঠকগুলোতে রিসেন্ট মনিটরিং ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড আউটলুক, ইন্টারেস্ট রেট ডেভেলপমেন্ট, সরকারি বন্ড, মনিটারি এক্সচেঞ্জ রেট, রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট, ব্যাংকিং ইস্যুস, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, এক্সটার্নাল লোন ডিসবার্সমেন্ট আইএমএফ টিএ রিপোর্টস, রিসেন্ট ট্রেড পারফর্মেন্স, রিসেন্ট এক্সচেঞ্জ পারফর্মেন্স, রিস্ক বেসড সুপারভিশন এবং টেকনিক্যাল মিটিং অন এএমএলের বিষয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া ফাইন্যান্সিয়াল ডেটা, অন্যান্য বড় চ্যালেঞ্জ, বপ রেটেড ম্যাটার্স, মনিটারি পলিসি স্ট্র্যাটেজি, এক্সচেঞ্জ রেট প্রেসার, ইনস্টিটিউশনাল অটোনমি অ্যান্ড গভর্নেন্স, কমার্শিয়াল ব্যাংক পারফরমেন্স এবং এফএসএপি আপডেটের বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের জন্য আগামী ঋণ কর্মসূচি ছাড়াও আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি ১৫ দিনের সফরে এসেছে।
এর আগে প্রথম পর্বের বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ জানান, আইএমএফ ঋণ পাবে কি-না সে বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত হবে। আগামী ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং ২ ও ৮ নভেম্বর আবার বৈঠক হবে। মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল আগামী ৯ নবেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এ মিশন ঢাকায় এসেছে।
এদিকে আইএমএফের কাছে চাওয়া সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মোট তিন কিস্তিতে আসবে এ ঋণ। এটা পেতে আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের ঋণ দেওয়ার শর্তাদি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ঋণ কত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে তা নির্ভর করছে সংস্থাটির সফররত প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের ওপর। তবে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত হতে পারে এবং ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফের শর্ত মেনে নিলে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া সম্ভব। তবে সে ঋণ পরের বছরের শুরুতে অর্থাৎ আগামী জানুয়ারিতে মিলতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সফররত প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন আইএমএফ বোর্ডে জমা দেওয়া হবে। প্রতিবেদনের পরই ঋণ পাওয়া যাবে। আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ সবশেষ ২০১২ সালে ঋণ নিয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। ওই সময় ঋণ নেওয়ার আগে কর নীতিতে কিছু সংস্কার এবং ভ্যাট চালু করা হয়। তবে তারা মুদ্রার বিনিময় ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।