বিদেশে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা
মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ,রকেট ও উপায়ে লেনদেন
অনলাইনে জুয়ার ৩৩১টি সাইট বন্ধ
করেছে বিটিআরসি নাছির উদ্দিন শোয়েব: ‘অনলাইন ক্যাসিনো’ বা জুয়ায় আসক্ত হচ্ছে দেশের বহু যুবক-তরুণ। শিক্ষার্থী এবং বেকাররাও জড়িয়ে পড়ছে এই নেশায়। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে একাউন্ট খুলে বন্ধু এবং পরিচিতজনদের নিয়ে শুরু করা যায় এই জুয়া। একসময়ে বোর্ড বসিয়ে বা তাসের মাধ্যমে চলতো জুয়া খেলা। এখন যে কোনো স্থানে বসে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সহজেই জুয়ার আড্ডা বসানো যায়। সম্প্রতি এই অনলাইন জুয়া বেড়েছে। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এতে আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। খোয়া যাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অনেকে সব হারিয়ে পথে বসেছে। ডিজিটাল এই জুয়ার মাধ্যমে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দু’চারজন গ্রেফতার হলেও এই জুয়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে, দোকানে, বাসা-বাড়িতে কিংবা নির্জন স্থানে বসে মোবাইলে এই জুয়া চলছে অহরহ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর বাড্ডার আফতাবনগর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, মহল্লায় সবজি বিক্রেতা মোঃ জসিম (ছদ্মনাম) দোকান চালিয়ে ভালোভাবেই সংসার চালাচ্ছিল। দুই রুমের বস্তি ঘরে ভাড়ায় থেকে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চলতো দোকানের উপার্জনে। গত তিন মাস ধরে সে ঘরে আর টাকা নিয়ে আসছে না। দোকানেও মালামাল নিয়মিত ওঠাচ্ছে না। স্ত্রী ও ছেলেরা পরে জানতে পারে দোকানের পুঁজি ও লাভের টাকা দিয়ে সে জুয়া খেলছে সে। নিজের মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই এভাবে অনলাইন ‘ক্যাসিনোতে’ সর্বস্বান্ত হয়েছেন ওই সবজি বিক্রেতা। এভাবে আরও একজন মাছ বিক্রেতার বাবা জানান, তার ছেলে প্রতিদিন সকালে এলাকায় মাছ বিক্রি করতো। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে জুয়া খেলে সব হারিয়েছে। এভাবে ওই এলাকার বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া যায় যারা নিয়মিত অনলাইনে জুয়া খেলে একরকম পথে বসেছে। এ গেলো দিন আনে দিনখায় এমন কয়েকজনের কথা। এছাড়াও আরও কয়েকজনের নাম জানা গেছে, যারা উচ্চ শিক্ষিত-যুবক। কয়েকজন বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে যারা বাড়ি থেকে পড়াশোনার জন্য টাকা এনে অনলাইনে জুয়া খেলে হারিয়েছে।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনলাইন জুয়া এখন দেশের নতুন আতঙ্ক হয়ে পড়ছে। এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে।
পাঁচ-দশ হাজার টাকার বিনিয়োগে শুরু করে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। অবাক করা বিষয় হচ্ছে-রাশিয়া থেকে পরিচালিত জুয়ার সাইট বেটউইনার (নবঃরিহহবৎ) ও ১ীনবঃ-সহ একাধিক সাইটে বাংলাদেশীদের লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় যুক্ত। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, অনলাইন জুয়া সব থেকে বেশি খেলে থাকেন শিক্ষার্থীরা। অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী খেলার চিপস কিনতে প্রয়োজন পড়ে ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড। এখন সেটাও সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকে পড়ে অনলাইন জুয়ার দিকে। এক সময় তারা এ খেলায় আসক্ত হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। সিটিটিসির ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের’ একজন কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগ পেলেই সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এরই মধ্যে এ অপরাধের দায়ে অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। অনলাইন জুয়াবিষয়ক একটি আইন করার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ জানায়, ৭০ থেকে ৮০ গুণ লাভের লোভ দেখিয়ে ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত জুয়ার সংখ্যা বিক্রি করা হয়। একজন একাধিক সংখ্যা কিনতে পারতেন। দিনে দুবার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে একজন বিজয়ী হয়ে লাভবান হলেও নিঃস্ব হয়ে পথে বসত হাজারো মানুষ। দিনমজুর, ট্রলিচালক, কয়লাশ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে জুয়ার এজেন্টরা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চলে যায় সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে যায় ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। চলতি অক্টোবরের ১০ তারিখ ৩৩১টি অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা সেল’। সেলটির নিয়মিত নজরদারির অংশ হিসেবে এসব অবৈধ সাইট বন্ধ করা হয়।
পুলিশ জানায়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খেলা ঘিরে দেশেও তৈরি হয় বিশাল অনলাইন জুয়ার সিন্ডিকেট। এই জুয়ায় বছরে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। একটি চক্রের তিন মাস্টার এজেন্টকে গ্রেফতার করার পর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসময় পুলিশ জানায়, তিনজনের কারও সাধারণ আয়ের উৎস নেই। পুলিশ জানায়, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে টার্গেট শ্রেণিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় জুয়ার নেশা। এতে অংশ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক মানুষ। একইসঙ্গে মাস্টার এজেন্টরা পিবিইউ বা ভার্চুয়াল কারেন্সি কম দামে কিনে তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করত চক্রটি। তবে প্রত্যেকেরই আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, গাড়িসহ বিপুল অবৈধ সম্পদ। বলছি অনলাইনে বেটিং বা জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী তিন মাস্টার এজেন্টের কথা। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে চক্রের এই তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছে থাকা ১টি গাড়ি, নগদ ১১ লাখ ৮০ টাকা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ২৩টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, গত এক বছরেই অনলাইন জুয়া থেকে পাওয়া ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পাচার করেছে তারা।
গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে অনলাইনে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ তাদেরকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে অনলাইনে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ে ব্যবহৃত ৫টি মোবাইল ফোন ও ৭টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়। এ বিষয়ে গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল হক তখন জানান, গ্রেফতারকৃতরা ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে জুয়া ও অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনা করতো। বেটিং সাইট ও মোবাইল অ্যাপস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ দু’টির গঠন প্রণালীতে প্রথমে রয়েছে সুপার এডমিন, তারপর পর্যায়ক্রমে ম্যানেজার, ভিআইপি এজেন্ট এবং সর্বশেষে ইউজার। মূলত সুপার এডমিন ফ্রান্স থেকে ওয়েবসাইট ও অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন দেশে দেখভালের জন্য বেশ কিছু ম্যানেজার নিয়োগ করা আছে। সংশ্লিষ্ট ম্যানেজাররা কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকা টার্গেট করে সেখানে একজন এজেন্টকে অধিক কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। এজেন্টরা মূলত ইউজার সংগ্রহে সহায়তা ও বিভিন্ন সমস্যা হলে সরাসরি ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করে সমাধানের কাজ করে। এজেন্টগণ সদস্য সংগ্রহ করে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং তথা পিরামিড সিস্টেমে কমিশন পেয়ে থাকে।
তিনি বলেন, এজেন্টরা ২ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ হারে রেফারেল কমিশন পেতো। তাছাড়াও এজেন্টরা একজন নতুন গ্রাহকের একাউন্ট খুলতে ৩ হাজার ২০০ টাকা নিতো। নতুন গ্রাহক একাউন্ট খোলার পর তাকে বিভিন্ন মেয়াদে ডিপোজিট বা বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হতো। ৩ দিন থেকে ৪৫ দিনের বিনিয়োগে ২.৭ শতাংশ থেকে ৩.১ শতাংশ হারে প্রতিদিন মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো। বেশি মুনাফায় আকৃষ্ট হয়ে গ্রাহক বা ইউজাররা বিনিয়োগ করতো। নতুন সদস্যদের ৩ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকার ডিপোটিজট বা বিনিয়োগে ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৭৭৭ টাকা পর্যন্ত আপলাইন গ্রাহককে কমিশনের অফার করতো। তাছাড়াও নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য রেফারেল কারীকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক আয়ের অফার করতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃত সাদ্দাম হোসেন এজেন্ট এবং সহিদুল ও আলমগীর তার সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। গ্রেফতারকৃত সাদ্দাম বিভিন্ন এলাকায় থেকে ইউজার সংগ্রহ করে মোবাইল অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট তৈরি ও তাতে ডিপোজিট করতে সহায়তা করতো। বিনিময়ে তিনি মোটা অংকের একটি কমিশন পেতেন।