কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর আনজুয়ারা বেগম দীর্ঘদিন থেকে কিডনি সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খবর পেয়ে তাঁর ভাই বগুড়ার শাজাহানপুরের বিহিগ্রামের বাসিন্দা আরাফাত হোসেন বোনের বাড়ির উদ্দেশে শনিবার সকালে রওনা দেন। সিএনজি অটোরিকশায় বগুড়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে জানতে পারেন, বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাস চলাচল শুরু হলে তিনি রংপুরগামী একটি গাড়িতে ওঠেন।
আরাফাতের মতো অনেক যাত্রীই গতকাল শনিবারও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য বাস টার্মিনালসহ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অপেক্ষা করেছেন পরিবহনের জন্য। বাস না পেয়ে অনেকে ট্রাক কিংবা বিভিন্ন কোম্পানির পিকআপে করে গন্তব্যে রওনা দেন। এতে চরম দুর্ভোগের পাশাপাশি দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া গুনতে হয়েছে তাঁদের।
রংপুর বিভাগে ৩৬ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে এভাবে বিভিন্ন জরুরি কাজকর্মে বের হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষ। অনেকে অটোভ্যান, অটোরিকশা, সিএনজিতে করে অতিকষ্টে গন্তব্যে পৌঁছেন।
মহাসড়কে নছিমন, ভটভটি, থ্রি-হুইলার অটোরিকশাসহ ছোট ছোট যানবাহন বন্ধের দাবিতে এই ধর্মঘট ডাকে রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতি। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, রংপুরে গণসমাবেশে জনসমাগম ঠেকানোর জন্য এ ধর্মঘট ডেকেছেন তাঁরা। শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে শনিবার দুপুর ২টা থেকে বাস চলাচল শুরু করা হয়। কোথাও কোথাও তার আগেই বাস বের করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উত্তরের আট জেলার উদ্দেশে আসা লোকজনকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানা মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কামরুল ইসলাম (২০), নাজমুল হক (২০) ও সুরুজ মিয়াসহ (২০) প্রায় ৩০ জন যুবক রংপুর ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করেন। তাঁরা পাবনার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।
সরাসরি রংপুরের বাস না পেয়ে পাবনা থেকে সিরাজগঞ্জ রোড হয়ে বগুড়া থেকে গোবিন্দগঞ্জে পৌঁছেন দুপুর দেড়টার দিকে। এরপর রংপুরের বাস না পেয়ে ছোট ছোট পরিবহনে করে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেন। একপর্যায়ে তাঁরা ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। প্রতিবন্ধী হাবিবুর রহমান (৫০) বগুড়া মহাস্থান থেকে মালপত্রসহ বস্তা কাঁধে নিয়ে পলাশবাড়ীর উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু গোবিন্দগঞ্জে পৌঁছে বাস না পেয়ে বসে ছিলেন তিনি।
লালমনিরহাটে দ্বিতীয় দিনের মতো বাস চলাচল বন্ধ ছিল। কালীগঞ্জ উপজেলার চাপারহাট ইউনিয়নের শাহিনুর দুপুর ১২টায় ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে বিকেলে লালমনিরহাট শহরের কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ডে এসেছেন। কখনও হেঁটে, কখনও অটোতে করে এক ঘণ্টার পথ আসতে তার সময় লেগেছে চার ঘণ্টা। রোববার তাঁর চাকরিতে যোগদান করার কথা। বাস বন্ধ, কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছবেন সেই চিন্তায় তিনি শঙ্কিত।
বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন শ্রমজীবী মানুষ। গত দু’দিনে যাত্রী না পেয়ে আর্থিক কষ্ঠে পড়েন রিকশা ও অটোরিকশা চালকরা। শহরের মিশনমোড় এলাকায় অটোরিকশাচালক শহিদুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাঁর রোজগার মাত্র ১৫০ টাকা। রাস্তায় লোকজন নেই।
ফুলবাড়ী বিএনপির বাহন ছিল অটোরিকশা: বাস ধর্মঘটের কারণে অটোরিকশায় করে শোভাযাত্রা নিয়ে রংপুর বিভাগীয় মহাসমাবেশে যোগ দেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা।
গতকাল সকালে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহম্মেদ চৌধুরী খোকন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা অধ্যক্ষ খুরশিদ আলম মতি ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নবীউল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিশাল অটোরিকশা শোভাযাত্রা পৌর শহরের সেনা মার্কেট মোড় থেকে ফুলবাড়ী-রংপুর মহাসড়ক দিয়ে রংপুর মহাসমাবেশের উদ্দেশে যাত্রা করে।
এ ছাড়া মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার শোভাযাত্রা নিয়ে ফুলবাড়ী-রংপুর মহাসড়ক দিয়ে দিনাজপুর সদর উপজেলা, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর, ঘোড়াঘাট উপজেলার নেতাকর্মীকে যেতে দেখা গেছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা বলেন, নদীতে বাঁধ দিয়ে যেমন জোয়ারের পানি আটকানো যায় না, তেমনি বাধা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের আটকানো যায় না।
এদিকে পরিবহন ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়েন ফুলবাড়ী-রংপুর মহাসড়কে যাতায়াতকারী সাধারণ যাত্রীরা। গতকাল সকালে পৌর শহরের ঢাকা মোড়ের রংপুর বাসস্টেশনে কথা হয় মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করেন। স্ত্রীকে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য গত বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন।
শুক্রবার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। যেতে পারেননি। এ জন্য মরিয়া হয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছেন। অটোরিকশায় চড়ে কুড়িগ্রাম জেলা শহরে এসেছেন দুপুর ১টার দিকে। মেইলবাস স্ট্যান্ডে এসে রংপুরের সাতমাথা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য অটোরিকশায় চড়ে রওনা দিয়েছেন। কখন-কীভাবে কর্মস্থলে পৌঁছুবেন তা অনিশ্চিত।
ধর্মঘটের প্রভাব পড়েনি ঠাকুরগাঁওয়ে: পরিবহন ধর্মঘটের প্রভাব পড়েনি ঠাকুরগাঁওয়ে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকায় যাত্রীরা নির্বিঘ্নে চলাচল করেছেন।
গতকাল সারাদিন কেন্দ্রীয় বাস ট্রর্মিনালের সামনে যাত্রীদের অপেক্ষায় বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও তেমন যাত্রী চোখে পড়েনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও চাহিদা মাফিক যাত্রী ছাড়াই চলাচল করেছে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর ও রংপুরগামী যাত্রীবাহী বাস। তবে যাত্রীদের অভিযোগ, তাঁদের রংপুরের কথা বলে বাসে তুলে সৈয়দপুরের রাবেয়া মোড়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে অন্য বাহনে রংপুরে পৌঁছাতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হয়েছে তাঁদের।
এদিকে পঞ্চগড়ে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বিআরটিসি বাসসহ সব ধরনের যানবাহন সরাসরি পঞ্চগড়-রংপুর রুটে চলাচল শুরু হয়। শুক্রবার সকাল থেকে পঞ্চগড়-রংপুর সরাসরি বিআরটিসি বাস বন্ধ থাকলেও পঞ্চগড়-দিনাজপুর রুটে গেটলক বাস সার্ভিস চালু ছিল। এ জন্য রংপুর, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারী সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। দুপুরে রংপুর রুটে বিআরটিসি বাসসহ যানবাহন চলাচল শুরু হলেও বাসে যাত্রীর তেমন চাপ ছিল না।