ফিরে আসছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ও বিপজ্জনক রোগ যক্ষ্মা। সংক্রামক রোগটি নতুন করে ফিরে আসার কারণ হিসেবে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্পষ্ট করেই যক্ষ্মার উত্থানের কারণ হিসেবে কোভিডকে দায়ী করেছে। সংস্থাটি বলছে, গত বছর পৃথিবীতে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগ ৩ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৪ সালের পর ২০২১ সালেই এত বেশি মানুষ ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া ওই বছর ‘চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার যোগ্য’ এমন সাধারণ যক্ষ্মায় সারা পৃথিবীতে মৃত্যু হয়েছে ১৬ লাখ মানুষের। যেখানে ২০২০ সালে মৃত্যু হয় ১৫ লাখ এবং ২০১৯ সালে মৃত্যুর সংখ্যাটি ছিল ১৪ লাখ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে তিন লাখ ৬১ হাজার যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। অপর দিকে যক্ষ্মায় বছরে প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ মারা যায়। শনাক্ত হওয়া রোগীদের ৮১ শতাংশ চিকিৎসা পায়, অবশিষ্ট ১৯ শতাংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রতিদিন অন্তত ৯৭৮ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর মধ্যে ১৬ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত। আক্রান্তদের মধ্যে দৈনিক মারা যাচ্ছে ১২৯ জন। ২০২০ সালে দেশে নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছিল দুই লাখ ৯২ হাজার ৯৪০ জন। অবশ্য চিকিৎসায় ৯৬ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বা এনটিপির হিসাবে ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। ২০১৯ সালে দেশে তিন লাখ যক্ষ্মা রোগীকে চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনা হয় এবং অবশিষ্ট ৫০ হাজারকে শনাক্ত করা যায়নি। তারা বলছেন, ৯৬ ভাগ রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যাচ্ছে। ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় প্রতি লাখে ৬৭ জন মারা গিয়েছিল কিন্তু এখন সেটি ঊনত্রিশে নেমে এসেছে।
এ দিকে দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই এই রোগের লক্ষণ গোপন করে যায়। একজন রিকশাচালক বা বস্তিবাসী মনে করেন, অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করলে তার উপার্জনে ক্ষতি হবে। মূলত এসব কারণে বড় একটা অংশ লক্ষণ গোপন করে আরো অসুস্থ হচ্ছে এবং অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়াচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোভিডের কারণে নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত কমে গেছে ৭ লাখ। যেখানে ২০১৯ সালে বিশ্বে নতুন যক্ষ্মা শনাক্ত হয়েছে ৭১ লাখ, সেখানে ২০২১ সালে হয়েছে ৬৪ লাখ। সংস্থাটি বলছে, লাখ লাখ মানুষ যক্ষ্মা চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তারা চিকিৎসা করাতে অসমর্থ হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সাড়ে ৪ শতাংশ যক্ষ্মা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে এক কোটি ৬ লাখ।
টিবি অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী মে স্পিগেল সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসসহ যক্ষ্মা আবারো সবচেয়ে বড় একক মরণঘাতী রোগে পরিণত হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে যক্ষ্মা পরিস্থিতির প্রতি নজর দিতে হবে।’ অনেক দিন থেকেই রোগটি কম গুরুত্ব পাচ্ছে। কোভিডকালে এই অবস্থা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত আমাদের যে উন্নতি ছিল রোগটি চিকিৎসা ও শনাক্তে তা কমে গেছে। যক্ষ্মা রোগে আমাদের যে লক্ষ্য ও অঙ্গীকার ছিল তা থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিরাজমান যে ওষুধ আছে তার কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা এখন ‘সুপারবাগ’ হয়ে উঠছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালে যে ১৬ লাখ মানুষ মারা গেছে যক্ষ্মায়, তাদের মধ্যে দুই লাখ ছিল এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, যক্ষ্মা বিশ্বব্যাপী ১৩ নম্বর মরণঘাতী রোগ, কিন্তু একক সংক্রামক রোগ হিসেবে দ্বিতীয় একক মরণঘাতী রোগ।
বিশ্বে যত যক্ষ্মা রোগী আছে তার মধ্যে আট দেশেই রয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ। এসব দেশ হলো- ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশ। যক্ষ্মা যে শুধু দরিদ্রদের হয়, তা নয়; যেকোনো সময় যে কেউ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারেন যদি শরীরে রোগটির প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ডায়াবেটিস, কিডনির রোগ, অপুষ্টি, মদ্যপান, মাদক সেবন, ধূমপান যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়ায়। গর্ভবতী নারী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি, কেমোথেরাপি কিংবা দীর্ঘ দিন স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে যক্ষ্মার ঝুঁকি থাকে। ঝুঁকির তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে করোনা। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে অনেকেরই যক্ষ্মার ঝুঁকি বেড়েছে।
যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত ছোঁয়াচে রোগ। এ রোগে সংক্রমিত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে রোগটি হতে পারে। তবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত সব রোগীর কাছ থেকে জীবাণুটি ছড়ায় না। হাঁচি-কাশি, এমনকি কথা বলার সময়ও বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ জীবাণু বেশ কয়েক ঘণ্টা বাতাসে ভেসে থাকে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় সুস্থ ব্যক্তির ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে বাতাসে ভেসে থাকা জীবাণু। এভাবেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। অপরিশোধিত দুধ পানের মাধ্যমেও যক্ষ্মার জীবাণু ছড়াতে পারে। ঘনবসতি বা আবদ্ধ স্থানে এ জীবাণু অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হাড়, মস্তিষ্কের আবরণ, কিডনি, অন্ত্র ও প্রজনন অঙ্গকে আক্রমণ করতে পারে। যক্ষ্মা হলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি, কাশির সাথে কখনো কখনো রক্ত বের হওয়া, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস, জ্বর এবং রাতে ঘাম হতে পারে।