এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী
চলমান ছাত্র রাজনীতির অপচ্ছায়া পড়েছে ছাত্রী রাজনীতির উপর। একটা সময় ছাত্র রাজনীতি ছিল মেধা ও আদর্শনির্ভর। মেধাবীদের দৃপ্তপদভারে মুখরিত ছিল শিক্ষাঙ্গনগুলো। তখন পেশী শক্তির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও মেধাশক্তির মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো এ অঙ্গনে। স্বাধিকার আন্দলোনে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীরাও এগিয়ে এসেছিল দেশ ও জাতি গঠনে, দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর, কোথায় নেই ছাত্রীরা। অথচ আজ সময়ের পরিক্রমায় ছাত্র রাজনীতির এ অঙ্গন যেমন হয়েছে কলুষিত তেমনি ছাত্রীসমাজও পিছিয়ে নেই এই কলুষতা থেকে। সম্প্রতি ইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা-গোটা ছাত্রী সমাজকে করেছে কলঙ্কিত। দেশবাসীকে করেছে হতবাক ও স্তম্ভিত। কী দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে গোটা দেশ। নারীশিক্ষায় দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ৩৫ হাজারের মত। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত আছে এ কলেজের হাজার হাজার প্রাক্তন ছাত্রীসমাজ। অথচ একের পর এক অনৈতিক ও বিতর্কিত ঘটনায় আজ এ প্রতিষ্ঠানের অতীতের সকল অর্জন, সুনাম ও মর্যাদা ক্ষুণœ হতে চলেছে ও নানান অপ্রীতিকর ঘটনার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ইডেন মহিলা কলেজে ক্ষমতাসীন দুই গ্রুপের একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
* গত শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাত থেকে ক্ষমতাসীন দলের দু’পক্ষের ছাত্রীদের সংঘর্ষ শুরু হলে সাধারণ ছাত্রীসমাজ আতঙ্কিত ও জিম্মী হয়ে পড়ে। শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হয় এবং হুমকির মুখে পড়ে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রীরা দু’পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিলে শুরু হয় হতাহাতি-মারামারি। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। ঘটনার সহিংসতায় ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশ করে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে।
* এই ঘটনা ও পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সংবাদ মাধ্যমে বেরিয়ে আসে ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্রীদের অপরাধের সব অবিশ্বাস্য ও ভয়ঙ্কর কীর্তিকলাপ।
ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি- তামান্না জেসমিন ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সিটবাণিজ্যসহ ছাত্রীদের জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করা, ছাত্রী নির্যাতন ও মারধরসহ নানান ধরনের কুৎসিত চিত্র গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসে।
মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, ৬টি হলের মোট ৩৮টি কক্ষ বর্তমানে তাদের দখলে। প্রতিটি কক্ষে অর্থের বিনিময়ে কমপক্ষে আটজন করে ৩২০ জন ছাত্রীকে রাখছেন। বিনিময়ে প্রতি মাসে মাথাপিছু সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা করে আদায় করেন তিনি। শুধু সিট ভাড়া থেকেই মাসিক আয় হয় ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
শুধু সিটবাণিজ্য নয়, আগস্ট মাসেই হলের ওয়াইফাই প্রোভাইডারের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা, চারটি হলের ক্যান্টিন থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে কলেজের এ দুই নেত্রী। এই টাকা ভাগাভাগি নিয়েই নেত্রীদের মধ্যে তীব্র অন্তর্কোন্দল সৃষ্টি হয়।
* সাংবাদিক সম্মেলনে অপর গ্রুপের সদস্যরা বলেন- পদ লাভের কয়েক মাস পার না হতেই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন তারা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুমে গিয়ে বেপরোয়া ক্ষমতা দেখানো, রুম দখলে নিয়ে ছাত্রীদের টেনে হিঁচড়ে বের করে দেওয়া, গলায় পা দিয়ে চেপে ধরাসহ নানা হুমকির অডিও ফাঁস হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সভানেত্রী অডিওতে কলেজ অধ্যক্ষের চেয়েও নিজেকে ক্ষমতাধর বলে দাবি করেন। হল কর্তৃপক্ষ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় থেকে তিনি নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন।
কখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুমে গিয়ে তাদের থেকে চাঁদা দাবি করেন আবার কখনো হুমকি দেন হল থেকে বের করে দেয়ার। এসব ঘটনা জেনেও চুপ থাকেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। যেন এই কলেজে উনি একাই একশো। তাদের মতে প্রশাসনের নীরবতা, গাফিলতি এবং অদূরদর্শীতার কারণে এসব ঘটনা প্রায় প্রতিবছরই ঘটেছে। হল প্রশাসন ও কলেজ প্রশাসন এর নীরবতার কারণ কী?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রীরা জানায় এর নেপথ্য কারণ তারাও এখান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পাচ্ছে। তাই প্রশাসন বরাবরের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ না নিয়ে, নির্যাতিতদের সহায়তা না করে তার পক্ষ নিচ্ছিলো। সাংবাদিকরা জানান- কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যকে বার বার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি এমনকি তিনি ঘটনা স্থলেও আসেননি। এতবড় ঘটনা ঘটে গেল, এত অনিয়ম আর দুর্নীতির খবর বেরুলো, অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ওপিনিয়ন এলো না, শাস্তিমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো না।
* এ ঘটনা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রী রাজনীতির থলের বিড়াল বের হওয়ার জোগাড় হয়েছে। সবাই বলছে এটাই দেশজুড়ে এ দলের মৌলিক চেহারা ও বৈশিষ্ট্য। ঘটনার আরো ভেতরে গিয়ে জানা যায় যে- গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগ নেতার বাসায় থাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় স্বর্ণা নামের সহ-সভাপতি গ্রুপের কর্মীর উপর চড়াও হয় সভাপতি গ্রুপ। যার ধারাবহিকতায় এ ঘটনার জন্ম। সাংবাদিকরা বলেন, একাধিক ছাত্রীর সাথে কথা বলে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
* এদিকে সাংবাদিকদের কাছে সভাপতি অভিযোগ করেন সহ-সভাপতি গ্রুপের ভর্তি বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে। সহ-সভাপতি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সভাপতি ও তার সহযোগিদের জুনিয়র ছাত্রীদেরকে দেহ-ব্যবসায় বাধ্য করার প্রমাণ সাপেক্ষ কাহিনী।
* সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ হুমকির মুখে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বললেই চলে। . ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেত্রীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুমে গিয়ে বেপরোয়া ক্ষমতা দেখানো, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজি, ইন্টারনেট সার্ভিস থেকে চাঁদাবাজি, মুদিদোকান থেকে চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে শতাধিক কক্ষ দখল, কু-প্রস্তাব দিয়ে ছাত্রীদের জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করাসহ নানাবিধ অপকর্মের কারণে সাধারণ ছাত্রী ও অভিভাবক মহলসহ গোটা জাতি শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
* সচেতন দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমরা এ সব অন্যায় কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। দোষী ব্যক্তি যারা নিরীহ ছাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি।
* দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে- চলমান অপরাজনৈতিক পরিবেশের শিকার আমাদের ছাত্রীরাও। আগে ছাত্র হলগুলোতে যে চিত্র দেখা যেত এখন আমাদের ছাত্রীরাও তা থেকে কোন অংশে পিছিয়ে নেই। ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠান যেন গুটিকয়েক মস্তান ছাত্রীর হাতে জিম্মী হয়ে আছে। পর্দার অন্তরালে হলের এ পরিবেশ দেখে অভিভাবক ও সাধারণ মানুষেরা যেন আঁৎকে উঠেছে।
কী চলছে এসব ছাত্রী হলগুলোতে। সত্যিকার অর্থে যা বেরিয়ে এসেছে তার ভেতরের কাহিনী আরোও কলুষিত, আরো অন্ধকার। একটি বাস্তব ঘটনা না বললেই নয়- একবার কোন এক কাজের প্রয়োজনে, কোন এক ছাত্রী হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কথায় কথায় হলে গার্ডের দায়িত্ব পালনরত লোকটি আমায় যা বললো তা হুবহু এখানে তুলে ধরলাম। তিনি বলেলেন- ছাত্রীদের এখানে যে অবস্থায় দেখি। তাদের মা-বাবা জানে না যে, টাকা পয়সা খরচ করে তারা তাদের সন্তানদের কোথায় পাঠাচ্ছেন। আর তারা কী করে বেড়াচ্ছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বক্ষণিক ডিউটিরত একজন অর্ধ-শিক্ষিত মানুষের স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতার টুকরো বাক্য এটি। যা সকল অভিভাবককে চিন্তিত না করে পারে না। বিশেষ করে অনৈতিক পরিবেশ ও ক্ষমতাসীন। দলের বেপরোয়া গতি প্রশাসনসহ সকলকে আতঙ্কিত করে রেখেছে।
* এ পরিস্থিতি উত্তরণে কর্তৃপক্ষকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা কলেজ অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকরী হস্তক্ষেপ আশা করছি।
* ছাত্র রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ সমস্ত অনৈতিক কাজের আখড়া এমন সকল অপরাজনীতি হতে ছাত্রী সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। আদর্শিক ও সমাজ গঠনমূলক কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামীর স্বপ্ন ছাত্রীসমাজকে পরিবারের আদর্শ মা ও জাতীয় পর্যায়ে নারী সমাজের নেতৃত্বের জন্য উপযুক্ততা অর্জন করতে হবে। আমরা আশা করছি, সকল সচেতন ছাত্রসমাজের হাতে সকল অপরাজনীতির কবর রচিত হবে ইনশাআল্লাহ্।
মহান আল্লাহ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সকল অনৈতিকতার পথ পরিহার করে আত্মগঠনের সাথে সাথে দেশগড়ার জন্য উপযুক্ত হিসেবে গড়ে ওঠার তৌফিক দিন।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম