মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা সঞ্চয় তুলে নেয়ায় আমানতে তৈরি হয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এতে ব্যাংকে হঠাৎ টাকার আকাল দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছর শেষে আমানতে ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে আমানত যোগ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৯ দশমিক ১৪ শতাংশ কম। এর ধারাবাহিকতা চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতেও স্পষ্ট। বিষয়টি অর্থনীতির জন্য সুখকর নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে আমানত যোগ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৯ দশমিক ১৪ শতাংশ কম। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে আমানত যোগ হয়েছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। ওই সময়ে আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। জুলাই মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে কমেছে ৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের তীব্র সময় ২০২০-২১ অর্থবছরেও ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ওই অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে নতুন আমানত যোগ হয় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে আমানত যোগ হয় ১ লাখ ১৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমানত যোগ হয়েছিল ৯৬ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। মহামারির অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে আমানতের যে প্রবাহ ছিল, গত অর্থবছর শেষে তা সেই পর্যায়ে চলে গিয়েছে। আমানতে ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, মেয়াদি অর্থাৎ সঞ্চয়ী আমানতের পরিমাণ কমে গিয়েছে সবচেয়ে বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে মেয়াদি আমানত কমেছে ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে মেয়াদি আমানত যোগ হয়েছে ৯৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৪২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা কম। অর্থাৎ এক অর্থবছরে এ পরিমাণ সঞ্চয়ী আমানত কমেছে । ২০২০-২১ অর্থবছরে মেয়াদি আমানত সবচেয়ে বেশি ৪০ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। সে সময় মেয়াদি আমানত যোগ হয়েছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এছাড়াও ২০২১-২২ অর্থবছরে সাধারণ আমানতে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি নিয়ে যোগ হয়েছে ২৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। মুদ্রাবাজারে চলছে ডলার সংকট। চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। যার বিপরীতে টাকা আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে করে টাকার তারল্যে টান পড়েছে। নগদ টাকার সংকট মেটাতে অনেক ব্যাংক কলমানির পাশাপাশি এখন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। দুই মাস আগেও কলমানিতে ধার দেওয়া অনেক ব্যাংক এখন নিয়মিত টাকা ধার করছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীসহ এরকম কয়েকটি ব্যাংক আন্তঃব্যাংক কলমানির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ধার করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার হয়েছে। এ সময় রপ্তানি আয় ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলারে উঠেছে। রপ্তানি আয় অনেক বাড়লেও আমদানির সঙ্গে ব্যবধান বেড়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। একই সময়ে আবার রেমিট্যান্স ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নেমেছে। এতে করে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারে উঠেছে। এর আগের অর্থবছর যেখানে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪৫৮ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে আমদানি কমানোর বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির ফলে একদিকে টাকার তারল্যে টান পড়েছে, আরেক দিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্টের বকেয়া (১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার) পরিশোধ করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৭ দশমিক ০৬ বিলিয়নে নেমে এসেছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার। এ সব বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর জানান, বিষয়টি অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। ব্যাংক সুদ এখনও মূল্যস্ফীতির নিচে। ব্যাংকে টাকা সঞ্চয় করেন মধ্যবিত্ত ও নি¤œ আয়ের মানুষ। মূল্যস্ফীতির গড় হিসাব সরকারিভাবে যা প্রকাশ করা হচ্ছে তার চেয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের খরচ বাস্তবে অনেক বেশি। জীবন চালাতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন তারা। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিনি জানান, ব্যাংকে আমানতে সুদ কম হওয়ায় মানুষ অন্য কোথাও সঞ্চয় সরিয়ে ফেলতে পারেন। অনেকে ডলারেও বিনিয়োগ করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এটি খুঁজে দেখা প্রয়োজন আসলে টাকা গিয়েছে কোথায়। ব্যাংক আমানত কমে গেলে সেটি অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিতে পারে। তখন কর্মসংস্থান নিয়ে দেখা দেবে সংশয়। আর সুদহার নিয়ন্ত্রণ করা ব্যাংকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের সর্বোচ্চ দাম কত হবে তা পুননির্ধারণ করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এখন থেকে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা দেবে ব্যাংক। এতদিন এই দর ছিল ১০৮ টাকা। এছাড়া বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বিল নগদায়নের রেট প্রতি ডলার ৯৯ টাকা রাখা হয়েছে।
মুল্যস্ফীতির কারণে বেড়ে গেছে জীবন-যাত্রার ব্যয়। মানুষের জীবন-পরিচালনার খরচ যে বেড়ে গিয়েছে তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার দরের তথ্যে। খাদ্যপণ্যের মৌলিক ৩টি পণ্য চাল, তেল ও আটার দর টিসিবির তথ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরে ২০২১ সালের ৩০ জুন মোটা চালের দর ছিল প্রতি কেজি ৪৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৮ টাকা, মাঝারি দরের চাল ছিল ৫০ থেকে ৫৬ টাকায়, আর সরু চালের প্রতি কেজির দাম ছিল ৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায়। এক বছর পরে গত জুন শেষে ঢাকা মহানগরে মোটা চালের প্রতিকেজি দর ছিল ৪৮ থেকে সর্বোচ্চ ৫২ টাকা। এক বছরে মোটা চালের প্রতিকেজিতে ৪ টাকা বেড়েছে। শতকরা হিসাবে যা ৯ শতাংশ। মাঝারি দরের বিভিন্ন চালের মূল্য গত বছরে ব্যবধান ছিল ৬ টাকা, এ বছরে ব্যবধান ৮ ধেকে ১০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীতে বিভিন্ন দরের মাঝারি মানের চাল বিক্রিও হয় ৫২ থেকে সর্বোচ্চ ৬২ টাকায় প্রতি কেজি। এক বছর আগে যা ছিল ৫০ থেকে ৫৬ টাকায়। আর ৫৬ থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায় থাকা সরু চালের প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬৪ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকায়। সরু চালের দর প্রতিকেজিতে বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৫ টাকায়। টিসিবির পরিসংখ্যান বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন মানের মধ্যে সরু চালে ১৯ শতাংশ, মাঝারি মানের চালে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও মোট চালের দর বেড়েছে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। একইভাবে প্রতিকেজি খোলা আটার দাম বেড়েছে এক বছরের ব্যবধানে ৩৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আর প্যাকেটজাতে বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। খোলা ময়দায় প্রতি কেজিতে ৫৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও প্যাকেটজাতে বেড়েছে ৫৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। ভোজ্য তেলে প্রতি লিটারে (লুজ) ১২২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে এক বছরের ব্যবধানে ১৮৫ টাকা। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ৫২ ভাগ। এভাবে খরচ বৃদ্ধির প্রভাবে সার্বিকভাবে সঞ্চয় কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, কোনো ব্যাংক যেন ডলার নিয়ে কারসাজি করতে না পারে, সেদিকে কঠোর নজর রাখতে হবে। শোনা যাচ্ছে, ডলার থাকার পরও আমদানিকারককে বাজার থেকে সংগ্রহ করে দিতে বলছে কোনো কোনো ব্যাংক। আমদানিকারক তখন ব্যাংককেই যে কোনো দরে ব্যবস্থা করতে বলছেন। এভাবে বাধ্য হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি দরে এলসি খুলতে হচ্ছে। এ প্রবণতা রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হঠাৎ পরিদর্শনে যেতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রির ফলে টাকা আটকে যাচ্ছে। এতে করে তারল্যের ওপর টান পড়বেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে তারল্য বাড়াতে এরই মধ্যে সিএমএসএমই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এখান থেকে ব্যাংকগুলো মাত্র ২ শতাংশ সুদে অর্থায়ন নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। গম ও ভুট্টা উৎপাদন বাড়াতে নতুন করে আরও একটি পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম