আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা আর বনবিভাগের উদাসীনতার কারণে সুন্দরবনকেন্দ্রিক গড়ে উঠছে না পর্যটন শিল্প। এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা, রাতে অবস্থান, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বনদস্যু চক্রের উপদ্রবের কারণে সুন্দরবনকেন্দ্রিক সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। দীর্ঘদিনেও পর্যটকদের জন্য বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। বনের ভিতর ঘুরে দেখার জন্য ওয়াক ওয়ের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। আর এসব কারণেই ঠিক ওভাবে পর্যটক টানতে পারছে না সুন্দরবন। শুধুমাত্র সড়ক পথেই সুন্দরবন উপভোগ করা যায় বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের এই জেলায়। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলেও স্বপ্নের পদ্মা সেতু হয়ে অসংখ্য পর্যটকের ঢল নামার কথা ছিল সুন্দরবনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন এখনও দেখতে পায়নি সংশ্লিষ্টরা। ধারণা করা হয়েছিল পদ্মাসেতু চালু হলে সুন্দরবনে পর্যটকের সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়বে ৪-৫ গুণ। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতিবছর ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ^ পর্যটন দিবস পালিত হয়ে আসছে। সুন্দরবনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন ও দিবসটি পালন করে আসছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন সুন্দরবনের মোট আয়তন ৩৫৭৩.২৮ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুলনা জেলার সুন্দরবনের আয়তন ২০৭২.২৪ বর্গ কিলোমিটার। বাকিটা সাতক্ষীরা জেলাধীন। এ বন ঘেঁষে সাতক্ষীরার অবস্থান হওয়ায় সড়কপথ দিয়েই সুন্দরবন দেখা যায়। বাংলাদেশের ৬টি জেলাজুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত হলেও একমাত্র সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ এলাকা থেকে সরাসরি দেখা যায় সুন্দরবনের সবুজ আবহ। মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালেই নদীর ওপারে চোখে পড়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ‘ব্র্যান্ড’ সুন্দরবন। শুধুমাত্র সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার জায়গা মান্দারবাডড়য়া সাগর সৈকত। এছাড়া কলাগাছিয়া, দোবেকি, কটকা, কচিখালি, বঙ্গবন্ধুর চর, হিরণ পয়েন্ট ও দুবলার চরে খুব সহজেই যেতে পারেন পর্যটকরা। মুন্সিগঞ্জ থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকার মাধ্যমে যাওয়া যায় এই দর্শনীয় স্থানগুলোতে। এত বেশি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পর্যটন কর্পোরেশন থেকে এখনো পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো কোনো কাজই হয়নি এই এলাকায়। অথচ এই সম্ভাবনাময় খাতকে রাখা হয়েছে শিল্পের পর্যায়ে।
চোখ জুড়ানো, শিহরন জাগানো অরণ্য সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ, গোলপাতার সুন্দরবন। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ বাংলাদেশের সুন্দরবন। সুন্দরবন বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশের রক্ষাকবচও। ঝড়ঝঞ্ঝা নিজের শরীর দিয়ে আটকে দিয়ে পুরো দেশকে রক্ষা করে এই সুন্দরবনই। প্রকৃতির ‘অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য’ কথাটা অবলীলায় শুধু এই বনকে নিয়েই বলা যায়। নদী, খাল ও সমুদ্র আর রহস্যঘেরা বনভূমি এই সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বনের মায়াবী রূপের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়ায়,শিহরন জাগায় প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। সুন্দরবন ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। খুব ভোরে এক রূপ, দুপুরে অন্য রূপ, পড়ন্ত বিকাল আর সন্ধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে হাজির হয়। মধ্য ও গভীর রাতে আবার তার আরেক রূপ। অমাবস্যায় ভয়াল সুন্দর আবার চাঁদনি রাতে রুপালি রূপ ধারণ করে সুন্দরী সুন্দরবন পর্যটকদের বিমহিত করে আসছে। বনের ভয়ংকরতা, বাঘের গর্জন, হরিণের চকিত চাহনি, বানর আর হরিণের বন্ধুত্ব, কুমিরের কান্না, পাখপাখালির কলতান, শ্রবণ সুখ, বনের বিভিন্ন বৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নৈস্বর্গিক দৃশ্য মিলেমিশে একাকার। আবার অশান্ত পানির বুকে উত্তাল ঢেউয়ের উন্মাদ নৃত্য অবলোকন করে পর্যটকরা উল্লসিত, বিমোহিত ও আপ্লুত হয়। বিশ্ব ঐতিহ্য স্বীকৃতি ও প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের পর থেকে সুন্দরবন নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীসহ বিশ্ববাসীর আগ্রহের শেষ নেই।
সুন্দরবনকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন ও আনন্দদায়ক করে তুলেছে সুন্দরবন ঘিরে মুন্সিগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠা আকাশলীনা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার। এছাড়া পর্যটকদের থাকার জন্য রয়েছে মুন্সিগঞ্জের কলবাড়িতে অবস্থিত বর্ষা রিসোর্ট ও ট্যুরিজম সেন্টার। আবাসিক সুবিধা রয়েছে মুন্সিগঞ্জের আকাশলীনা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারেও। একইসঙ্গে মুন্সিগঞ্জে রয়েছে সুশিলনসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিলাসবহুল রিসোর্ট। এখানে স্বল্প খরচে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম এ হাসান জানান, সুন্দরবন একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন খুবই আকর্ষণীয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন ঢাকা থেকে সকালে এসে সুন্দরবন ঘুরে বিকেলে চলে যেতে পারবেন পর্যটকরা। এখানে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন ঘোরার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। সাতক্ষীরা টুরিস্ট জনের ইনচার্জ মহসিন আলম বলেন, পর্যটকদের যথাযথ নিরাপত্তা দেয়ার জন্য টুরিস্ট পুলিশ সদা সর্বদা নিয়োজিত। অতীতে কিছু পর্যটক হয়রানি হলেও বর্তমানে সেটি শূন্যের কোঠায়।
পশ্চিম সুন্দরবনের বুডড়গোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা নুর আলম বলেন, পর্যটকদের সুন্দরবনকে আকৃষ্ট করতে পর্যটন স্পটগুলো আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। কলা গাছিয়াতে কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র তৈরির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে করমজল থেকে তিনটি কুমির আনা হয়েছে। এছাড়া পর্যটকরা যাতে হরিণ দেখতে পায় সেজন্য হরিণের শেড তৈরি করার কাজ চলমান। তিনি আরো বলেন, গতবছর সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন ৫০ জন বিদেশী ও ৫১,৪৮০ জন দেশী পর্যটক। রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮ কোটি ৫৭ লক্ষ ৮০ টাকা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, পর্যটনকে সম্প্রসারণ করার জন্য প্রচার প্রচারণা অব্যাহত আছে। অযথা কোন পর্যটক যেন হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য উপজেলার দর্শনীয় স্থান গুলোতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সহ সার্বিক বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের সার্বক্ষণিক মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
পর্যাটকদের সেবা ও সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই পর্যটনশিল্প থেকে সরকার বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম