বৈদেশিক বাণিজ্যের রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান ছিল ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। ছয় বছরে এ খাতে ব্যবধান দ্বিগুণেরও বেশি।
রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হারে বেড়ে যাওয়ায় দেশের শিল্প খাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। দীর্ঘদিনেও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি শিল্প খাত। ফলে এখন এসে খাতটি বড় ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে গেলেই শিল্প খাত বড় সংকটে পড়ে। যেমনটি পড়েছে বর্তমান বৈশ্বিক কারণে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ছে। এতে শিল্পায়ন ও রপ্তানিও বৃদ্ধির কথা। আমদানির কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করলে দেশে মূল্য সংযোজন হয়ে থাকে। এতে আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে তার উলটো। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বাড়ছে দ্বিগুণ। আমদানির বিকল্প পণ্য দেশে চাহিদা অনুযায়ী এবং মানসম্পন্নভাবে উৎপাদন হচ্ছে না বলেই আমদানি বাড়ছে বলে অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে শিল্প খাতে আমদানির এত অর্থ ব্যয় হয় সেগুলো কোথায় যাচ্ছে। আমদানির নামে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ উঠছে। বিশেষ করে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে বেশি পাচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে টাকা পাচারের হচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আমদানি-রপ্তানি দুভাবেই দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। যে কারণে শিল্পের নামে আমদানি বাড়লেও তার প্রতিফলন ঘটছে না শিল্প খাতে। রপ্তানিও বাড়ছে না। ’৮০-র দশক থেকেই দেশে শিল্পায়ন শুরু হয়েছে। সে তুলনায় গত চল্লিশ বছরে দেশে শিল্প খাত একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু তা হয়নি। আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি না হলেও দুটোর মধ্যকার ব্যবধান কমার কথা। তা না হয়ে বরং বেড়েছে। এখন আমদানিজনিত কারণে দেশ বড় ঝুঁকিতে পড়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে যে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে তা আমদানিজনিত কারণে। চড়া দামে বেশি পণ্য আমদানি করায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি আমদানির তুলনায় বাড়ছে না। ফলে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। এতে আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা পুরো অর্থনীতিকে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অথচ শিল্প খাতে আমদানিনির্ভরতা কমলে সংকট এত প্রকট হতো না। ডলার সংকটের কারণে এখন আমদানিনির্ভর শিল্পগুলোও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আনতে পারছে না। ফলে তাদের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩০৮৯ কোটি ডলার, আমদানি হয়েছিল ৪০২৫ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি বা বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ৯৩৬ কোটি ডলার। আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান ছিল ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের আমদানি হলে রপ্তানি হয়েছিল ৭০ কোটি ডলারের। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩৩০ কোটি ডলার। আমদানি হয়েছিল ৫০৫২ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি বা বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ১৭২৩ কোটি ডলার। ওই বছরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান বেড়ে ৫১ দশমিক ৭৪ শতাংশে ওঠে। অর্থাৎ ওই বছরে ১০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হলে রপ্তানি হয়েছিল ৪৮ কোটি ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩৯৬০ কোটি ডলার। আমদানি হয়েছিল ৫৫৪৪ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হয়েছিল ১৫৮৪ কোটি ডলার। এ খাতে ব্যবধান ছিল ৩৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হলে রপ্তানি হয়েছিল ৬০ কোটি ডলার।
আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান বৃদ্ধি প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার ব্যবধান এখনো বাড়ছে-এটা হওয়ার কথা নয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে এতদিন পণ্য আমদানি করে সেগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশে শিল্পের আমদানিতে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়ের প্রতিফলন শিল্প খাতে কতটুকু পড়েছে-তা খতিয়ে দেখার বিষয়।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩২৮৩ কোটি ডলার। আমদানি হয়েছিল ৫০৬৯ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হয়েছিল ১৭৮৬ কোটি ডলার। দুই খাতের ব্যবধান ছিল ৫৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩৬৯০ কোটি ডলার। আমদানি হয়েছিল ৬০৬৮ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হয়েছিল ২৩৭৮ কোটি ডলার। দুই খাতে ব্যবধান বেড়ে ৬৪ দশমিক ৪৩ শতাংশে দাঁড়ায়।
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৪৯২৫ কোটি ডলার। আমদানি হয়েছিল ৮২৫০ কোটি ডলার। রপ্তানির চেয়ে আমদানি রেকর্ড পরিমাণে বেশি বা বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ৩৩২৫ কোটি ডলার। দুই খাতে ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হলে রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ৩২ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, আমদানির চেয়ে রপ্তানি কম হলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে। গত ছয় বছরে বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এই বাণিজ্য ঘাটতিকে সহজভাবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আমদানির বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় ঠিকভাবে দেশে আসছে কিনা তাও দেখা জরুরি। দুই খাতে ভারসাম্য না হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই হবে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় স্বস্তি ফিরবে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনার সময় থেকে রপ্তানি আয় দেশে আসার ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হচ্ছে। অনেক ক্রেতা দেউলিয়া হয়ে গেছে। বাজার ধরে রাখতে অর্থ না পেলেও রপ্তানি করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমদানির একটি বড় অংশ হচ্ছে জ্বালানি, ভোগ্য ও বিলাসী পণ্য। জ্বালানির বড় অংশই ব্যবহৃত হচ্ছে ভোগে। দেশে পাঁচতারা হোটেলের সংখ্যা বাড়ছে। এগুলোর প্রায় সব সেবাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ভারত ভোগে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কম। কিন্তু বাংলাদেশে এ খাতে খরচ অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মোট আমদানির মধ্যে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালে ব্যয় হচ্ছে ৫৭ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা। জ্বালানি তেল আমদানিতে ৯ শতাংশ। এছাড়া ভোগ্যপণ্যে ১২ শতাংশ, বিলাসী পণ্যে ৭ শতাংশ। অন্যান্য খাতের আমদানি ব্যয় হচ্ছে ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে শিল্প খাতের পণ্যও রয়েছে।
সোর্স : যুগান্তর