3
শুকুর মিয়া। পরিবার নিয়ে উত্তরায় থাকেন। বয়স ৬৭ বছর। ছেলে মাদকাসক্ত। নিজের নামে বাবার ব্যবসা এবং ফ্ল্যাট লিখিয়ে নিয়ে এখন স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বসবাস করেন। সম্প্রতি শুকুর মিয়া একা বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রতিবেশী এবং এক পরিচিত চিকিৎসকের সহায়তায় তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই প্রতিবেশী জানান, এক সময় নিজের ছেলেকে সুস্থ করার জন্য শুকুর মিয়া আমার কাছে ছেলের চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসতেন। এখন তাকে দেখার কেউ নেই। মাদকাসক্ত ছেলে এখন সুস্থ জীবনে ফিরলেও বাবার কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তাকে আমরা নিজ তাগিদে হাসপাতালে ভর্তি করি।
বিজ্ঞাপন
মান্নান হাওয়ালাদার একজন সরকারি চাকরিজীবী। বয়স ৭০ বছর। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে একান্নবর্তী সংসার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের নিয়ে বেশির ভাগ সময় মেতে থাকতেন। বিপত্তি বাধে চাকরি থেকে অবসরে আসার পরে। পেনশনের টাকা ভাগবাটোয়ারা এবং জমিজমাকে কেন্দ্র করে ছেলেমেয়েরা একসময় তার চিরশত্রুতে পরিণত হয়। ভেঙে যায় তার একান্নবর্তী সংসার। জীবদ্দশায় সন্তানদের নামে জমি লিখিয়ে নিতে তারা রীতিমতো বাবার গায়ে হাত তুলতো।
পরবর্তীতে সংসারে শান্তি আনতে একসময় সন্তানদের নামে জমি- পেনশনের টাকা আলাদাভাবে বণ্টন করে দেন। এরপর সবাই যে যার সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন একা থেকে পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর মানসিক সমস্যা থাকায় এখন একাকিত্ব বার্ধক্য জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শামীম মিয়া। বয়স ৬০ বছর। ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করেন। সম্প্রতি তার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। মাঝেমধ্যে ছেলেদের কাছে বেড়াতে গেলেও ঢাকার বাসায় এখন একাকি জীবন কাটে তার। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি যান। সেখানে প্রতিবেশী এবং ভাই-বোনদের সঙ্গে সময় কাটান। ছেলেমেয়ে এবং বন্ধুরা একাধিকবার বিয়ের কথা বললেও প্রথম স্ত্রীর প্রতি তার প্রবল ভালোবাসার কারণে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। মো. আমির হোসেন। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। সন্তানরা পড়ালেখার উদ্দেশ্যে বিদেশে অবস্থান করছে। স্ত্রী তার অফিস, শরীর চর্চা, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতেই ব্যস্ত। এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ জানান, সামাজিক বন্ধনের কারণে একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও তারা যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। প্রয়োজনীয় দু’একটি কথা ছাড়া খুব বেশি কথা হয় না তাদের। রাজনীতি থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন।
মর্জিনা বিবি। বয়স ৭৫ বছর। কিশোরী বয়স থেকে শরীরে শ্বেতি রোগ বহন করছেন। জন্ম, বেড়ে ওঠা বগুড়ায়। রাজধানীর পান্থপথের একটি ছাত্রীনিবাসে প্রতিদিন নবম তলা থেকে ১৩ তলায় উঠে খাবার পরিবেশনের কাজ করেন। প্রায়সই তাকে খাবারের বড় বালতি এবং গামলা বহন করতে দেখা যায়। বয়সের ভারে যেন নুইয়ে পড়েছেন। এত বয়সে তিনি এই কাজ কেন করছেন? জানতে চাইলে মর্জিনা বলেন, সাধে কী আর এই কাজ করি। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। তিন সন্তানকে নিয়ে অথৈ পাথারে পড়ে যাই। ছেলেমেয়েদের সুখের চিন্তা করে দ্বিতীয়বার আর বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। ছেলে চাকরি করে। যা বেতন পায় সেটা দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলতে পারে না বলে ছেলে বলে দিয়েছে। তাই ছেলে-বউয়ের কাছে বোঝায় পরিণত হতে চাইনি। তারা নিজেরা খেতে পারলেও মাকে খাওয়াতে পারবেন না। মর্জিনা বলেন, ছেলেমেয়েরা বগুড়া থাকে। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়। নাতি-নাতনিদের দেখতে খুব ইচ্ছা করে। তারা এখন আর খোঁজ নেয় না। বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছ থেকে সুরক্ষা দেবার জন্য ২০১৩ সালে ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন’ প্রণয়ন করে সরকার। এই আইনে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী কোনো সন্তান তার পিতা-মাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস বা অন্য কোথাও আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না।
পিতা-মাতার জন্য ভরণ-পোষণ এবং চিকিৎসার ব্যয় মেটানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে এই আইনে এবং সন্তানরা যদি এসব দায়িত্ব পালন না করে তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আইন অনুযায়ী পিতা-মাতা আইনের আশ্রয় নিলে ১ লাখ টাকা জরিমানা। অথবা ৩ মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহল করিম বলেন, ছেলেমেয়ে ছোট বয়সে যে পরিবেশে বেড়ে উঠবে বড় হলে তারা পরিবারের সঙ্গে তেমন আচরণ করবে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ এতটাই কম যে বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার দায়িত্ব গ্রহণের চেয়ে তাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পতির ঝোকটা বেশি। কাজেই এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষাটা একজন সন্তানের জন্য বেশি জরুরি। যার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী জীবনে বাবা মায়ের প্রতি তারা কতোটা দায়িত্ববান এবং যত্নশীল হবেন। ঢাকা মেডিকেলের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক মো. রাজিব বলেন, শেষ বয়সে সন্তানদের অবহেলার কারণে অনেক সময় বাবা-মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আমাদের ধর্মেও স্পষ্ট করে বলা আছে শেষ বয়সে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের কতোটা দায়িত্ববান হতে হবে। এখন আমি সন্তান হয়ে যদি নিজের মা-বাবার খোঁজ না নেই পরবর্তীতে জীবনে সেটা আমার ওপরই বর্তাবে। শেষ বয়সে বাবা-মায়ের নিঃসঙ্গতা কাটাতে সন্তানের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের আচরণগত পরিবর্তন আসে। এই সময়টাতে তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে চায়। পেশাগত কারণে সন্তানরা দূরে থাকলেও তাদের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। ১৯৮১ সাল থেকে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান। তার সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের। তিনি বলেন, বার্ধক্য আমাদের অবধারিত। বিজ্ঞানের প্রশারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ৬০ বছর বয়সী বয়স্কদের বলা হয় প্রবীণ। প্রবীণ আসলে ৩ ধরনের। ৬০-৭০ বছর বয়সীরা তরুণ প্রবীণ, ৭০-৮০ বছর বয়সীরা মধ্যম প্রবীণ এবং ৮০ থেকে তদূর্ধ্বরা অতি প্রবীণ। মধ্যম প্রবীণ বয়সে মানুষ বেশি অবসাদে ভুগতে শুরু করে। জীবনের বাস্তবতায় এখন পরিবার থেকে সেরকম সাপোর্ট পায় না তারা। এ কারণেই প্রবীণদের বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা ভাবনা জরুরি।
সোর্স : মানব জমিন