ডিমের হালি আবারো ৫০ টাকায় উঠে গেছে। যেকোনো প্রকার সবজি ৭০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি পণ্যের দামই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমে গেছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মানুষ এখন জমানো অর্থ ভেঙে ফেলছে। আর এরই প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রে। গত আগস্টে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় শতভাগ। বিপরীতে বেড়েছে উত্তোলনের হার। ব্যাংকের গড় আমানতের হার বেড়েছে ৮ শতাংশ, যেখানে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বাদ দিলে থাকে ২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে আমানতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্টে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৮ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে বিনিয়োগ হয়েছিল ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এক মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ কমেছে প্রায় শতভাগ। অপর দিকে, গত বছর জুলাই-আগস্ট দুই মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছিল যেখানে ৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৪০১ কোটি টাকা।
শুধু সঞ্চয়পত্রেই বিনিয়োগ কমেনি, ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুলাইতে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সোয়া ১৩ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের জুলাইতে তা কমে হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। তবে, ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতের মোট আমানত থেকে এক টাকা না বাড়লেও আপনা-আপনিই ৭ থেকে ৮ শতাংশ বেড়ে যায়। কারণ, আমানতের প্রতি ১০০ টাকায় আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে আমানতের সুদহার বাদ দিলে নিট আমানতের প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ২ শতাংশ, আর মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে আমানতের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। ৮৪ টাকার ডলার উঠে গেছে ১১০ টাকায়। বিপরীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু যে হারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, বিপরীতে মানুষের আয় বাড়েনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমে গেছে। বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদের আয় বাড়েনি। একদিকে করোনা ভাইরাসের প্রভাব, অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের নিট আয় কমে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানের ধকল সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো চালু রয়েছে, বেশির ভাগের বেতনভাতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কমে যাওয়া বেতনভাতাও ঠিক মতো পরিশোধ করতে পারছে না। একদিকে পণ্যের দাম েেড় গেছে, বিপরীতে আয় কমে যাওয়ায় মধ্যবিত্তের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ব্যয়ের সাথে আয় কুলাতে না পারায় মানুষ এখন জমানো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। আর এরই প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রে নিটি বিনিয়োগসহ সার্বিক আমানত প্রবাহে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় না কমালে ডলারের চাহিদা কমবে না। ডলারের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পণ্যের আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এক দিকে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, সেই সাথে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে সাধারণের দুর্ভোগ অসহনীয় আকারে দেখা দিয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে জ্বালানি তেলের আমদানিতে বাড়তি কর কমিয়ে তেলের দাম কমানো যাবে। এতে কিছুটা হলেও দুর্ভোগ লাঘব হবে সাধারণ জনগণের।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। যেমন- প্রতি ডলার ৯৪ টাকা মূল্য ধরে পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল মাস দেড়েক আগে। যখন পণ্য দেশে এসেছে তখন প্রতি ডলারের জন্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১০ টাকা। তাও চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংস্থান করতে পারছে না ব্যাংক। এখানেই প্রতি ডলারের জন্য তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ১৫ টাকা। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করার প্রভাব। একসাথে প্রায় ৫১ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, কমানো হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদন পর্যায়ে। সাথে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। একজন উদ্যোক্তা জানান, এসব কারণে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ৫০ শতাংশ থেকে শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। এতে পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে মানুষ। ফলে লোকসান কমাতে শ্রমিক ছাঁটাইসহ কারখানার ব্যয়ও কমিয়ে আনতে হচ্ছে।
ব্যাংকারররা জানিয়েছেন, এমনিতেই একশ্রেণীর উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করেন, এর সাথে নতুন করে জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে অনেক প্রকৃত উদ্যোক্তাও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারাবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
এ দিকে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকারে পৌঁছেছে। কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল যেখানে ৬.০৫ শতাংশ, সেখানে মার্চে ৬.২২ শতাংশ, জুনে এসে আরো বেড়ে হয় ৭.৫৬ শতাংশ এবং জুলাইতে এসে ৭.৪৮ শতাংশ হয়। যদিও বাস্তবের সাথে এর তেমন কোনো মিল নেই বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, গত এক মাসে সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। চাল থেকে শুরু করে সবধরনের পণ্যের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত মাসে ডিমের হালি যেখানে ১২০ টাকা ছিল চলতি মাসে তা বেড়ে হয়েছে দেড় শ’ টাকা।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সামনে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অপর দিকে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষের আয় নির্ধারিত। বরং অনেক প্রতিষ্ঠান মাসের বেতন মাসে পরিশোধ করতে পারছে না। এ মুহূর্তে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের সামনে খাবার রেশনিং করা ছাড়া আর কোনোই বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা।
সোর্স : নয়া দিগন্ত