দেশ-বিদেশে থেকে যখন আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করার দাবি উঠেছে; তখন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের চেয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট করাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে যেস বদল সংলাপে অংশ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে আওয়ামী লীগসহ ৪টি দল ইভিএমে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। অন্য দলগুলো ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। অথচ ইভিএমে নির্বাচন করতে এবং ওই যন্ত্র ক্রয়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি পাল্টিয়ে দিয়ে ১৭টি দল ইভিএমের দাবি করেছে বলে প্রচার করছে। যদিও কয়েকটি দল ইসির এই দাবির প্রতিবাদ করছে। এরোই মধ্যে ৮৭১১ কোটি ব্যয়ে ২ লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয়ের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রশ্ন হলো ইসির ইভিএমে ভোট করা এবং ইভিএম ক্রয়ের প্রতি এতো ঝোক কেন? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমে ভোট করার প্রস্তাব করছে সে জন্য নাকি ইভিএম ক্রয় প্রকল্প থেকে নিজেদের পকেট ভারী করতে? সরকারের মন্ত্রীদের ক্রয় বিক্রয়ের খরচেও জবাবাদিহিতা করতে হয়। কিন্তু ইসির দায়িত্বপ্রাপ্তরা কি জবাবাদিহিতার উর্ধ্বে? কাজী রকিবউদ্দিন ও কে এম নূরুল হুদার নের্তৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সময়ে ইভিএম ক্রয়ের হিসেবে কি দেয়া হয়েছে? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
Adipolo
Adipolo
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, গত ২০১৮ সালের নির্বাচনে আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে মহা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাকে আবেদন করা হয়েছিল তারা অডিট রিপোট আমাদের দেয়নি। একই ভাবে ২০১৮ সালে যারা মধ্যে রাতে ভোট করলো তাদের আয়-ব্যয়ের প্রকাশ করা হয়নি। আমরা বলেছিলাম ২০১৮ সালে যারা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে মধ্যে রাতে ভোট করেছে এসব কর্মকর্তার আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থেকে ৭ বছর জেলা দেওয়া উচিত ছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এমপি মন্ত্রীরা দুর্নীতি করলে মামলা ও বিচার হয়। অথচ নির্বাচন কমিশনে যারা আসে অপরাধ করে তাদের বিচার হয়না। অথচ ইভিএম বাণিজ্য হচ্ছে।আমরা দুর্নীতিবাজ কমিশনের কর্মকতা ও জড়িতদের বিচার দাবি করছি।
বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইভিএম ক্রয়ে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা (৪৫০ মিলিয়ন ডলা) ব্যয় করা হয়েছে। এসব টাকার সঠিক ভাবে ব্যয় হয়েছে কি না এখনো তার হিসেব দেখাতে পারেনি কমিশন। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এ ধরনের বিপুল ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক তানিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবার ২ লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে ইভিএম ব্যবহার না করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন দেশের ৩৯ নাগরিক।
আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সামনের দিনে নির্বাচনে ব্যবহারযোগ্য ইভিএমের ঘাটতি তৈরি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। ১৫০টি ইভিএমে নির্বাচন করতে হলে নতুন মেশিন কেনায় অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। গত ২০১৪ সালে কাজী রাকিবউদ্দিন কমিশনও একই ভাবে দুর্নীতি আশ্রয় নিয়েছে। তার কোনো বিচার হয়নি। রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা দুনীতি না করেও তাদের বিচার হচ্ছে। অথচ নির্বাচন কমিশনের কমিশনার থেকে শুরু করে সকলেই দুনীতির করছেন তাদের বিচার হচ্ছে না এবং জবাবদিহীতার আওতায় আনা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে ভোটারদের ১০ আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া ঘোষণা দিয়েছে কমিশন।
চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন আগের কমিশন কাজী রকিব উদ্দিন ও কে এম নুরুল হুদার পথ অনুসরণ করতে থাকেন। দফায় দফায় রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরদ সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করলেও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের সুপাশি ও পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে না। বরং আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী জাতীয় সংসদের অর্ধেক আসনে (১৫০) ইভিএমের ভোগ গ্রহণ ঘোষণা দেন। আর ইভিএমের পক্ষে জনমত গঠনে অধ্যাপক জাফর ইকবালের নেতৃত্বাধীন কিছু তাবেদারকে দিয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে ইভিএমের ভোটে কারচুপি হয় না বলানোর চেস্টা করেন। এমনকি হঠাৎ করে ইসি’র সঙ্গে সংলাপকালে ১৭টি রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে বলে জানায় ইসি। পরে সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে জানতে পারেন সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব পাল্টে দিয়েছে ইসি। ওই সব দল এ নিয়ে প্রতিবাদ করেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ইসিতে নিবন্ধিত চারটি দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বেশির ভাগ দল ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে। এমনকি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টিরও ইভিএমের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নেই। এরপরও ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইসি। এসব রাজনৈতিক দলের মতামতকে পাল্টে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, যে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ যে গুরুত্বহীন ছিল তা সুস্পষ্ট হয়েছে। আগামীতে কমিশনের সাথে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের সংলাপও অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ইভিএমও তেমন হবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম ইনকিলাবকে বলেন, আগে কেনা ইভিএমের মধ্যে ২৮ হাজার অকেজো হয়ে গেছে। এসব ইভিএমের আয়ুষ্কাল একেক দেশে একেক রকম। ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ইভিএম সচল থাকে। দেশে চার বছরের মধ্যে কেন ইভিএমে সমস্যা তৈরি হলো, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কমিশনের উচিত ছিল এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ইভিএমে কী কী সমস্যা হচ্ছে, তার একটি পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ ও চিত্র নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি অংশীজনদেরও এগুলো জানানো উচিত। কারণ, নির্বাচন মানে স্বচ্ছতা। এই স্বচ্ছতা না থাকলে আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়।
এদিকে ইসিতে পাঠানো দেশের ৩৯ নাগরিকের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল› (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি পুনঃগণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান মরহুম জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়। প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা যায়। বায়োমেট্রিক্সভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না, কমিশন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদেরকে তাদের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেওয়ার তথা ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে। যে কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফলাফল নিয়েও কারসাজি করা যায়। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কারিগরি টিমও নির্বাচনী ফলাফল বদলে দিতে পারেন।
নির্বাচন কমিশন গত চার বছরে সারা দেশের আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা কার্যালয়গুলোতে মোট ৯৩ হাজার ইভিএম পাঠিয়েছিল। এর ৩০ শতাংশ বা প্রায় ২৮ হাজার ইভিএম সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারায় অকেজো বা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখন ইসি বলছে, ওই ইভিএমগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি। মেরামত করে আবার ব্যবহার করা যাবে। ইতিমধ্যে সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এই অবস্থা হয়েছে বলে মনে করে ইসি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২০১৮ সালে আগে ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প নেয় নির্বাচন কমিশন। ওই প্রকল্পের অধীনে ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম কেনা হয়েছে। দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ৯৩ হাজার বিভিন্ন আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর বাইরে ৫৪ হাজার ৫০০ ইভিএম রাখা আছে গাজীপুরে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ)। আর ২ হাজার ৫০০টি ইভিএম আছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে। ওই প্রকল্পে ইভিএমের ১০ বছরের ওয়ারেন্টি বিক্রয়োত্তর সেবার নিশ্চয়তা থাকার কথা বলা হয়েছিল।
২০১০ সালের ১৭ জুন দেশে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রচলন শুরু করে বিগত ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। পরবর্তীকালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভোট নিতে গেলে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। সে মেশিনটি পরে আর ঠিক করতে পারেনি কমিশন। এরপর ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি কে এম নুরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ১ লাখ ৫৪ হাজার করে ইভিএম ক্রয় করে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে। গত সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকার বাইরে থাকা ইভিএমগুলোর অবস্থা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন ইভিএম প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। দেখা গেছে, যে ৩০ শতাংশ ইভিএম ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
স¤প্রতি কমিশনের ডাকা সংলাপে যে ২২টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছে তার মধ্যে ১৪টি দল এটি নিয়ে তাদের সংশয় ও সন্দেহের কথা স্পষ্টভাবেই বলেছে। এর মধ্যে ৯টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আওয়ামী লীগসহ ৪টি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ যে ৯টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করেছিল, তারাও ইভিএমের বিপক্ষে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও সংলাপের সময়ে বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।
ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ইভিএম কিনতে নতুন যে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তাতে এই যন্ত্র সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউসে (গুদামঘর) রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই ইভিএমগুলোর পাঁচ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি বিক্রির পর নষ্ট হলে মেরামত করে দেওয়ার নিশ্চয়তা এবং সব যন্ত্রাংশের এক বছরের গ্যারান্টি আছে। ##
সোর্স : ইনকিলাব