দেশের ৬০ শতাংশ পথশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার, তবে তা প্রকাশ করে মাত্র ৫ শতাংশ। পথে পথে বেড়ে ওঠা এসব শিশুর তিন বেলা খাবার, মাথার ওপর ছাদ বা গায়ের কাপড় জোটে না। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড কিংবা রাস্তার পাশে রাত কাটে তাদের।
আজ ২ অক্টোবর সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় পথশিশু দিবস।
বিজ্ঞাপন
এ উপলক্ষে এসব শিশুর অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মী বলেন, রাজধানীর কমলাপুর, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুরা রাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কুলি, নৈশপ্রহরী, এলাকার বখাটে-মাস্তানদের দ্বারা পথশিশু ছেলে ও মেয়ে উভয়ই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ১২-১৩ বছর বয়স হলেই মেয়ে পথশিশুরা রাস্তাঘাটে বিচরণকারী নানা মানুষের কুনজরে পড়ে। অনেক শিশুকে কৌশলে যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ছেলে পথশিশুরাও নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। যেখানে এসব শিশুর একবেলা খাবার জোটানোই দায়, সেখানে তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয় তো অনেক দূরে। নিপীড়নের শিকার অনেক শিশু ভয়ে মুখ খোলে না।
বেসরকারি সংগঠন পথবাসী সেবাকেন্দ্র (সাজেদা ফাউন্ডেশন) জানায়, যৌন নিপীড়নের শিকার প্রায় ১৩ হাজার পথশিশুকে সেবা দিয়েছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০১৯ সালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ পথশিশু রয়েছে। ঢাকায় আছে সাত লাখ। গবেষণা তথ্যে বলা হয়, ২০২৪ সাল নাগাদ দেশে মোট পথশিশুর সংখ্যা হবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রতিটি শিশুই স্কুলে যাবে। একটি শিশুও ঝরে পড়বে না, রাস্তায় ঘুরবে না, টোকাই হবে না। পথশিশুরাও স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে কমলাপুর ও কারওয়ান বাজারে পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এই দুই কেন্দ্রে ১৬০ জনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পথশিশু সুরক্ষায় কিছু প্রকল্প চলমান। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ও বরিশালে সাতটি পুনর্বাসনকেন্দ্র রয়েছে।
দৈনিক ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা
বেশির ভাগ পথশিশু পেটের দায়ে কাজ করে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির গত মাসের এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা ভিক্ষা করে এসব শিশু। ৩৫ শতাংশ শিশু ভিক্ষা করার কথা স্বীকার করেছে। ৪২ শতাংশ শিশু রাস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করে। ৯৫.৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা করছে না।
পথশিশুর ওপর সহিংসতা
পথশিশুদের সহিংসতার চিত্র ভয়াবহ। যৌন নিপীড়নের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনও চলে তাদের ওপর। ৭৯ শতাংশ শিশু জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
ঢাকা ও বরিশালের ৪০০ শিশুর ওপর গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ শিশু মানসিক নিপীড়নের শিকার। এর মধ্যে পিতৃপরিচয় না থাকায় হেনস্তা হওয়া এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শোনাসহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তির শিকার হয় তারা। এতে তাদের মানসিক পীড়ন হয়। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ পথশিশু।
ঢাকা ও বরিশালে নির্যাতিত বেশি
ঢাকা ও বরিশালের পথশিশুদের জন্য সহিংসতা ও নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনা। নির্যাতনের শিকার অর্ধেকের বেশি শিশু বলেছে, তারা রাস্তা বা পার্কে বা কোনো খোলা জায়গায় নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে। অন্যরা বলেছে, ট্রেনে বা নৌপরিবহনে তারা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত লিডো ও যুক্তরাজ্যের কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন এবং কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের এক জরিপের ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
লিডোর গবেষণায় উঠে এসেছে, ৬২ শতাংশ পথশিশু গণশৌচাগার ব্যবহার করে। ৩০ শতাংশ শিশু নর্দমা বা খোলা জায়গা ব্যবহার করে। ৩৫ শতাংশ শিশু কাশি, ২৬ শতাংশ শিশু সর্দি, ২৫ শতাংশ শিশু মাথা ব্যথা এবং ২২ শতাংশ শিশু পেটের পীড়ায় ভোগার কথা বলেছে। ৮৫ শতাংশ শিশু অসুখ-বিসুখে হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার শিশুদরে জন্য যে থাকার জায়গার ব্যবস্থা রেখেছে, সেখানেও সুবিধা অপ্রতুল। শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা নেই সেখানে। এমনকি তারা খাবার পাচ্ছে কি না, যেসব সুযোগ-সুবিধা সরকার থেকে দেওয়া হচ্ছে, তা নিশ্চিত হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করারও কেউ নেই। এত বেশিসংখ্যক পথশিশুর জন্য এই সুবিধা একেবারে নগণ্য।
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পথশিশুদের নিয়ে স্বচ্ছ জরিপ করতে চাইলেও আমরা পারি না। নির্যাতন, সহিংসতা, মাদকাসক্তিসহ বিপর্যয়ের শিকার এসব শিশু। তাদের সুস্থ জীবন দিতে না পারলে মেয়েশিশু পাচার, যৌনকাজে বাধ্য করা, চুরি-ছিনতাইসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে। ’
সোর্স : কালের কন্ঠ