বর্তমান সভ্যতা কি পিছলে পড়ে পা ভাঙতে চাইছে? একটু সতর্ক থাকলে হয় না? পা ভাঙা তো কোনো ভালো কথা নয়। পা ভাঙলে অচল হতে হয়। তাই সাবধানে পা ফেলাই ভালো, পথটা যখন পিচ্ছিল। সাধারণ মানুষ তো পথটা পিচ্ছিল করেনি, বিশ^রাজনীতির পথটা পিচ্ছিল করেছে পরাশক্তিরাই। এই পথে যদি আবার পরমাণু অস্ত্র নামানো হয়, তাহলে শুধু পা নয়, পুরো প্রাণটাই খতম হয়ে যেতে পারে। প্রাণ কি শুধু রুশ ও ইউক্রেনীয়দের যাবে, নাকি পুরো মানবজাতিই এর শিকার হতে পারে? এসব বিষয়ে বাইডেন পুতিনরা কী ভাবছেন? তাদের থিংকট্যাঙ্করা কূটপরামর্শ দিতে দিতে কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা করার মত সামর্থ্য কি তারা হারিয়ে ফেলেছেন? এমনটি হলে তো পৃথবী নামক আমাদের প্রিয় এই গ্রহটির সামনে মহাবিপদ! রাশিয়া এবং আমেরিকার ভূ-রাজনীতি বিশ^বাসীকে নিয়ে এসেছে এই বিপদের মুখে। এমন ভূ-রাজনীতির কোনো প্রয়োজন আছে কি এই গ্রহে?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, দেশের ভূখন্ড রক্ষার জন্য তিনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত। কিন্তু তার সেনাবাহিনী তো এখন অন্য দেশের ভূমিতে অবস্থান করছেন। তবে পুতিনের মত ক্ষমতাধর ব্যক্তির ওই বক্তব্যে একটা আশঙ্কা তো সৃষ্টি হয়েছে। পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভও একই ধরনের কথা বলেছেন জাতিসংঘে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, রাশিয়া-ইউক্রেনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করলে মস্কোকে ‘বিপর্যয়কর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে। ২৬ সেপ্টেম্বর সোমবার রয়টার্স পরিবেশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার তৎপরতা এবং সেখানকার নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ মন্তব্যের পর রোববার ওই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য যে, পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেতস্ক, খেরসন এবং জাপোরিজিয়া-এর চারটি অঞ্চলে গণভোটের পর রাশিয়ান পার্লামেন্ট কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো অঞ্চলগুলোর সংযোজনকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে। ওই চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পর সেখানে কোনো হামলা হলে, সেটা রাশিয়ার ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখাতে পারে মস্কো। ফলে বলা চলে, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে। এছাড়া ইউক্রেনের দখলকৃত ভূখন্ডকে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করার কৌশল রাশিয়া এবং ন্যাটো সামরিক জোটের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান রোববার বলেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্তভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং এটি মস্কোকে ‘বিপর্যয়কর পরিণতির’ মুখোমুখি দাঁড় করাবে।
ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানে পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন কিনা, সেটি বর্তমান সময়ে একটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক সময় মনে করতেন, রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। কিন্তু এখন আর তা মনে করেন না। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রোববার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজকে তিনি জানিয়েছেন পুতিনের পরমাণু হামলার শঙ্কা জেলেনস্কি এখন বিশ^াস করেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। কারণ পুতিন জানিয়েছেন, রাশিয়ার ভূখ- রক্ষার জন্য ‘হাতে থাকা সকল উপায়’ মস্কো ব্যবহার করবে। আশঙ্কাজনক এমন পরিস্থিতিতে বিশ^নেতারা কী করবেন? বিশে^র নাগরিকদের কি কিছু করণীয় আছে?
কা-জ্ঞানহীন কোনো মানুষ পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কার মধ্যে প্রবেশ করতে চাইবে না। কিন্তু এখন তো তেমন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এমন শঙ্কায় সভ্যতার শাসকরা কি এক ধরনের উদাসীনতার মধ্যে বসবাস করছেন? আমরা মনে করি, পারমাণবিক উত্তেজনার পরিবেশকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা এখন কী করছেন? পুতিন তো গত ফেব্রুয়ারিতেই রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগারকে প্রস্তুত অবস্থায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ পুতিনের এমন নির্দেশকে মিথ্যে ভয় দেখানোর কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এমন বিবেচনাবোধকে সঠিক বলে ভাবা যায় না। বরং পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিবর্তনের চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি পুতিনকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তিনি অপমানিত হচ্ছেন। দেশে-বিদেশে প্রভাব হারাচ্ছেন। এমন অবস্থায় ক্ষুব্ধ পুতিন ভুল সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। পরিস্থিতি পাল্টাতে ইতোমধ্যে তিন লাখ অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পুতিন। আমরা জানি, সেনা সংখ্যা বাড়িয়ে যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা গেলেও সব সময় জেতা যায় না। এ জন্যই হয়তো পুতিন তার সামরিক আয়োজনে পারমাণবিক সম্ভাবনাকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যকে হয়তো এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন, ‘পিছু হটো, নয়তো পরিণতি মোকাবেলা করো।’
সাত মাস আগে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর এখনই সবচেয়ে বড় সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছেন পুতিন। ¯œায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এত বিশাল সেনা সমাবেশ আর লক্ষ্য করা যায়নি। উপলব্ধি করা যায়, যুদ্ধটা যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং অস্ত্রের ব্যবহারও যদি বাড়তে থাকে, তাহলে চূড়ান্ত অবস্থায় চূড়ান্ত অস্ত্র ব্যবহারে কোন নৈতিকতা পরাশক্তিকে বাধা দেবে? তাই এখনই কি উচিত নয় সভ্যতার শাসকদের মানবিক পথে হাঁটা? অর্থাৎ উত্তেজনা বন্ধ করে আলোচনার পথে কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা। কারণ পারমাণবিক যুদ্ধে বিজয় পতাকা উড্ডীন করার মতো কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম