বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ বেশি লবণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এসব খাবার থেকে এখনই লবণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে না পারলে মানুষের মধ্যে স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বাড়বে বলে গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। একই সাথে হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকিও বাড়বে। উচ্চ রক্তচাপ বাড়লে চোখ, কিডনিসহ শরীরের নানা অঙ্গ নষ্ট হতে পারে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ পরিচালিত ‘অ্যাসেসমেন্ট অব সল্ট কন্টেন্ট অ্যান্ড লেবেল কমপ্লায়েন্স অব কমনলি কনজিউমড প্রোসেসড প্যাকেজড ফুডস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিজলভ টু সেভ লাইভসের সহায়তায় গবেষণাটি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটের খাবারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে (৬১ শতাংশ) নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ। সামনের দিনগুলোতে প্যাকেটজাত খাবারে মানুষ এখনকার চেয়ে আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে প্যাকেটজাত খাবার থেকে এখনই অতিরিক্ত লবণ কমিয়ে আনতে না পারলে মানুষের মধ্যে স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বাড়বে। আর উচ্চ রক্তচাপ বাড়লে নষ্ট হতে পারে চোখ, কিডনিসহ শরীরের নানা অঙ্গ। একই সাথে হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকিও বাড়বে খাবারে লবণ কমাতে না পারলে।
গবেষণায় প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে সর্বোচ্চ ৭৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণকে নিরাপদ মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, বাজারে বহুল প্রচলিত ৬১ শতাংশ বিস্কুট, চিপস, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ঝালমুড়ি, আচার, চাটনি ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ রয়েছে। আর ৩৪ শতাংশ খাবারে নিরাপদ মাত্রার দ্বিগুণ অর্থাৎ ১.৫ গ্রামের বেশি লবণ পাওয়া গেছে।
দোকানে পাওয়ায় বহুল বিক্রীত চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ ও ঝালমুড়ির কোনোটিতেই নির্ধারিত মাত্রার লবণ পাওয়া যায়নি বরং এগুলোতে দ্বিগুণের বেশি লবণ রয়েছে বলে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। একইভাবে আচার ও চাটনির ৮৩ শতাংশ, চিপসের ৬৩ শতাংশ এবং ডাল-বুট ভাজার ৬০ শতাংশে দ্বিগুণ লবণ রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। চিপস, ডাল-বুটের যে নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে এদের একটিতেও নির্ধারিত মাত্রার লবণ পাওয়া যায়নি।
গবেষণাটিতে বাজারে বহুল বিক্রীত ১০৫টি ব্র্যান্ডের চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ঝালমুড়ি, চকলেট, আচার-চাটনি, চিপস, ডালবুট, সস, বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, কোমল পানীয় ও ফ্রুট ড্রিংকসের নমুনা পরীক্ষা করে এ ফলাফল পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণের সর্বোচ্চ কোনো সীমা সরকারিভাবে নির্ধারণ করা নেই। যার ফলে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যে ইচ্ছেমতো লবণ যোগ করতে পারছে। যদিও প্যাকেট খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০১৭ অনুসারে, ‘প্রক্রিয়াজাত খাবারে বিদ্যমান লবণের পরিমাণ মোড়কের লেবেলে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক।’ কিন্তু গবেষণায় প্রায় অর্ধেক (৪৪ শতাংশ) খাবারে মোড়কে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি লবণ পাওয়া গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষই এ জাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। গড়ে একজন ব্যক্তি সপ্তাহে ১৫ বার অর্থাৎ দিনে দুইবারের বেশি এসব খাবার গ্রহণ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। প্যাকেটজাত খাবারে অতিরিক্ত লবণ এর জন্য দায়ী।
গবেষণা প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগের ঝুঁকি কমানো হলে প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের মোড়কে পুষ্টি সম্পর্কিত তথ্য যথাযথভাবে উল্লেখ করাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে একজন ভোক্তা সহজেই বুঝতে পারেন খাবারটি স্বাস্থ্যকর নাকি অস্বাস্থ্যকর। গবেষণা মতে, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও খাবারের মোড়কের সামনের ভাগে লেবেলিং (ফ্রন্ট অব প্যাক লেবেলিং) প্রচলন করা হলে ভোক্তারা সহজে খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনে তা কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এর ফলে মোড়কে থাকা স্পষ্ট ও পাঠযোগ্য আকারের লেখা এবং চিহ্ন দেখে একজন ভোক্তা সহজেই বুঝতে পারবেন খাবারটি স্বাস্থ্যসম্মত হবে কিনা। গবেষণা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, প্যাকেটজাত খাবারে লবণের পরিমাণ যেখানে লেখা থাকে তা এমন স্থানে ছাপানো হয় যাতে ক্রেতা তা ভালো করে দেখতে না পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাজ করা স্থানে এসব থাকে। আর সবাই জানে এটা দেখা যায় না। এতে আরো বলা হয়েছে, খাবারে পুষ্টিগুণ অথবা লবণ এমন ছোট করে ছাপানো হয় যা ক্রেতা সহজে বুঝতে পারেন না। তারা খাবারটি তার জন্য ভালো কি মন্দ তা বিচার করার সুযোগ পান না।
গবেষণায় ১৪ ধরনের ১০৫টি প্যাকেটজাত খাবার পরীক্ষা করা হয়েছে। কোন কোন কোম্পানির খাবার পরীক্ষা করা হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি গবেষণার শর্ত হিসেবে। গবেষকরা বলছেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু খাবারে কী পরিমাণ লবণ আছে তা দেখা, কোন কোম্পানির খাবার তা দেখা নয়। তা ছাড়া গবেষণার নৈতিকতা থেকেই খাবারের নাম বা কোম্পানি প্রকাশ করা হয় না।
গবেষণা ফলাফল প্রকাশে উপস্থিত ছিলেন হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা: সোহেল আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষেল সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল আলিম, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, কনজুমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান প্রমুখ।
সোর্স : নয়া দিগন্ত