বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিরে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ডলারের একক দর নির্ধারণ করেছিলেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। কিন্তু ডলারের একক দর গত দুই সপ্তাহেও বাস্তবায়ন করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এখনো ব্যাংকভেদে আমদানিতে ডলারের পার্থক্য পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, যেসব ব্যাংক বেশি হারে রফতানি বিল নগদায়ন করছে তারা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু রফতানি বিলের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে তারা পূর্বনির্ধারিত দরের ধারে কাছেও আসতে পারছেন না। এ কারণে রফতানি বিল নগদায়নে এখন মরিয়া হয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলো। আর এতেই ব্যাংকের কাছে কদর বেড়েছে রফতানিকারকদের।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ডলারের মূল্য আকাশছোঁয়া অবস্থানে চলে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরেও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে ডজনখানেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। এমনি পরিস্থিতিতে শাস্তি এড়ানোর জন্য ব্যাংকাররা দফায় দফায় বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে। শর্তসাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে নেয়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রত্যাহার করেন। এর জন্য ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ডলারের একক দর নির্ধারণের ঘোষণা দিতে হয়। গত ১১ নভেম্বর থেকে ডলারের অভিন্ন দর কার্যকর করার ঘোষণা করে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করে এমন ব্যাংকারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)।
এর আগে তারা ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাথে যৌথ বৈঠক করে।
দীর্ঘ দুই সপ্তাহ আগে ডলারের অভিন্ন দর কার্যকর করার ঘোষণা দিলেও গতকাল পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছক অনুযায়ীই বাফেদা রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা, রফতানিকারদের ডলারের মূল্য ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ দুই দর গড় করে তার সাথে আরো এক টাকা যুক্ত করে ডলারের আন্তঃব্যাংক দর ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এ দর বেশির ভাগ ব্যাংকই কার্যকর করতে পারেনি। গতকালও ব্যাংকভেদে আন্তঃব্যাংকে ডলারের মূল্যের পার্থক্য ছিল পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকা। অর্থাৎ বৃহস্পতিবারও প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। সর্বনিম্ন বিক্রি হয়েছে ১০১ টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের এমন অস্থির অবস্থা সম্পর্কে ওই তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, এর মূল কারণ হলো রফতানি বিল নগদায়ন মূল্য ও রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্যের অসম পার্থক্য। তিনি বলেন, যেসব ব্যাংক বেশি হারে রফতানি বিল নগদায়ন করতে পারছে তাদের গড় মূল্য কম পড়ছে। কারণ, রফতানি বিল নগদায়ন করা হচ্ছে ৯৯ টাকায়। আর যেসব বিল রফতানি বিল কম নগদায়ন করতে পারছে, আর বেশি হারে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে তাদের ডলারের গড় মূল্য বেশি পড়ছে। কারণ, রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকায়। এ কারণেই ডলারের একক দরে আসতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আসলে রেমিট্যান্সের ডলারের সর্বোচ্চ মূল্য ১০৮ টাকা এবং রফতানি আয় নগদায়ন করতে ৯৯ টাকা কার্যকর করা গেছে। কিন্তু পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা কার্যকর করা এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না। এটা নির্ধারণ করার জন্য তারা গত পাঁচ কার্যদিবসের রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ও আন্তঃব্যাংক থেকে যে মূল্যে ডলার সরবরাহ করেছে তার গড়ের সাথে এক টাকা যুক্ত করে আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এভাবে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করতে ব্যাংকভেদে সাত টাকা পার্থক্য হয়ে গেছে। যে ব্যাংক রফতানি আয় বেশি নগদায়ন করেছিল ওই ব্যাংকের ডলারের গড় মূল্য ১০১ টাকা হয়েছে। কারণ রফতানি ডলারের মূল্য কমছিল বলে। আবার যে ব্যাংকের রফতানি আয় কম নগদায়ন করেছিল, কিন্তু রেমিট্যান্স বেশি দরে কিনেছিল ওই ব্যাংকের গড় ডলার মূল্য ১০৮ টাকা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, এমনিতেই বাজারে ডলার সঙ্কট চলছে, এই অবস্থায় ব্যাংকগুলো গ্রাহকের চাহিদার দিক বিবেচনা করে বেশি দরে ডলার কিনে আমদানি ব্যয় মিটাচ্ছে। এই অবস্থায় হঠাৎ করে একক দর কার্যকর করতে গেলে ব্যাংকগুলোকে বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। আবার কাক্সিক্ষত হারে ডলারও পাওয়া যাবে না। এ কারণে বাজারে একটি ভালো দর পেতে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
এমনি পরিস্থিতি নিয়ে আজ সোমবার বাফেদা ও এবিবি নেতৃবৃন্দের এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হবে। আজকের সভায় করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিছু কিছু ব্যাংকার দাবি করছেন, রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য ১০৮ টাকা থেকে আরো কমিয়ে দেয়ার জন্য। এ ছাড়া একক দর কার্যকর করা সম্ভব হবে না। তবে, সবকিছু নির্ভর করছে আজকের বৈঠকের সিদ্ধান্তের ওপর। তবে, রেমিট্যান্সের মূল্য আরো কমানো হলে রেমিট্যান্স-প্রবাহ আরো কমে যেতে পারে। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই।
সোর্স : নয়া দিগন্ত