প্রতিটি বজ্রনিরোধক ব্যবস্থায় খরচ প্রায় ১০ লাখ টাকা
আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের
১০ বছরে বজ্রপাতে প্রাণহানি ২ হাজার ৫৭৫ জন
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে গত ১০ বছরে প্রাণহানি হয়েছে ২ হাজার ৫৭৫ জনের। বজ্রপাতে বার্ষিক প্রাণহানির সংখ্যার বিচারে সারাবিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এই দুর্যোগ থেকে মানুষ ও প্রাণীদের রক্ষায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। আর এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে দুই ধরনের খরচ। প্রতিটির ব্যয় পার্থক্য হলো তিন লাখ টাকা। বজ্রপাত নিরোধক প্রতিটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তবে এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এই খরচের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে খোদ পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তাদের মতে বিভিন্ন খাতের ব্যয় আরো যৌক্তিক হওয়া উচিত।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর দুর্যোগপ্রবণ এবং জলবায়ু ঝুঁকিতের থাকা একটি দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটি প্রায় নিয়মিত সংঘটিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সাম্প্রতিক যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবেই বেশি বজ্রপাত হয়। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একটি গবেষণায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়। এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের পরিমাণ ১০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৫৭৫ জন। বেশি বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে চার বছরে নিহতের সংখ্যা ৫৬৭ জন। বজ্রপাতে মৃত্যুর ৯৩ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে। আর ৮৬ শতাংশ খোলা জায়গায় ঘটে। তবে বর্তমানে ক্রমান্বয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বজ্রপাতের প্রবণতা ও মৃত্যুর হার বিবেচনায় সরকার ২০১৬ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেশের বেশি বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানী রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এক হাজার ২৩২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। তিন বছরে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার ৩৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। জেলাগুলো হলো- দিনাজপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, পাবনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, বেশি বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় আইটিভিত্তিক অনলাইন পর্যবেক্ষণসহ ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন। বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় ৩ হাজার ৩৯৮টি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা। অ্যাপস ও এসএমএসের মাধ্যমে আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থার সফটওয়্যারসহ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং জনসাধারণের মধ্যে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফুটিং ফাউন্ডেশনে এক হাজার ৬৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে খরচ হবে ১৬৭ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এতে প্রতিটিতে ব্যয় হবে ৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। আর পাইল ফাউন্ডেশনের এক হাজার ৬৯৯টিতে ব্যয় ২১৮ কোটি ২৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এখানে প্রতিটিতে ব্যয় হবে ১২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। দুই ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় পার্থক্য হলো তিন লাখ টাকা। আবার গণপূর্ত অধিদফতরের ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রতি বর্গফুটে ব্যয় (পাইল ফাউন্ডেশনে) ৪ হাজার ২৮১.৭৮ টাকা। আর ফুটিং ফাউন্ডেশনের ব্যয় প্রতি বর্গফুটে ৩ হাজার ২৭৯.৫৫ টাকা। এই খরচকে যৌক্তিক করার জন্য বলা হয়েছে। যেখানে আবাসিক ভবনের খরচ প্রতি বর্গফুটেই ৪ হাজার টাকা। সেখানে আশ্রয়কেন্দ্রের খরচ ৪ হাজার টাকার বেশি।
অন্য দিকে ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য খরচ হবে ৬৬৫ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। যেখানে প্রতিটিতে ব্যয় হবে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। যার যৌক্তিকতা নিয়ে কমিশনের প্রশ্ন। কারণ প্রতি শতাংশ জমির দাম হবে ২ লাখ টাকা। আউট সোর্সিংয়ে যাবে ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের অভিমত হলো, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নি¤œমানের টেকনোলজি ব্যবহার করে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন করা হলে এবং সঠিকভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে প্রকল্পের সুফল থেকে দেশের মানুষ বঞ্চিত হবে। আর রাষ্ট্রের এই হাজার কোটি টাকা পানিতে যাবে। প্রকল্পে পাঁচটি যানবাহন এবং ৪০টি মোটরসাইকেল ক্রয়ের যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনবল কমিটির সুপারিশ প্রস্তাবনায় পাওয়া যায়নি।
সোর্স : নয়া দিগন্ত