ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়ছেই। বর্তমানে দেশে চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। চলতি মাসে গত মাসের চেয়ে দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায়ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪৪০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে ঘণ্টায় ১৮ জনের বেশি রোগী আসছেন হাসপাতালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ বহু রোগী আছেন যারা হাসপাতালে ভর্তি হন না। আবার অনেক হাসপাতালও আছে যারা ডেঙ্গু রোগীর তথ্য অধিদপ্তরে পাঠান না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডেঙ্গুর উপদ্রব থাকবে। তবে তা নির্ভর করছে বৃষ্টি কমার উপর।
শীত আসলে আস্তে আস্তে কমে আসবে। তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। মাঝে মাঝে যেসব অভিযান দেখি তা লোক দেখানো। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সম্ভাব্য যে সকল পাত্রে এডিস মশা জন্মায় বা জন্মা?নোর সম্ভাবনা র?য়ে?ছে; সেই সব পাত্র অপসারণ করা জরুরি। বর্ষা শুরুর আগেই সিটি মেয়রদের উচিত কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে, পাড়?া- মহল্লায় ভাগ করে স্থানীয় সমাজকর্মী এবং যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা। এডিস মশা যেহেতু সংক্রমিত মশা। এতে এক রোগী থেকে অন্যজন সংক্রমিত হয়ে থাকে। সিটি করপোরেশনকে এই বিষয়টি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো গেলে এই কাজ আরও ফলপ্রসূ হবে। গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৪০ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩০৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ১৩১ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৪৪০ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৫০ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ২৯৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩৫৪ জন। এতে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি ছিলেন ১৩ হাজার ৮৮০ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছিলেন ১২ হাজার ১৮০ জন। এই বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি মাসেই মারা গেছেন ২৯ জন। যা আগস্ট মাসে ছিল ১১ জন।
চলতি মাসে ৭ হাজার ৬৯৯ জন আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আগস্টে ছিল ৩ হাজার ৫২১ জন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ৯৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছিল। তার আগের বছর ছিল মাত্র ৪৭ জন। বর্তমানে রাজধানী ও তার আশেপাশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭২৪ জন ডেঙ্গু রোগী। অন্যদিকে ঢাকায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৫৭২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১২৩ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইতে ১ হাজার ৫৭১ জন এবং আগস্ট মাসে তা বেড়ে ৩ হাজার ৫২১ জনে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরের এই ২৫ দিনে আক্রান্ত হয়ে ৭ হাজার ৬৯৯ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ২৯ জন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জুনে ১ জন, জুলাইতে ৯ জন এবং আগস্টে ১১ জন। ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে আসে এডিস মশার মাধ্যমে। বর্ষায় বাসাবাড়িতে পানি জমে এই মশার বংশবিস্তার বেশি ঘটে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়।
মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরের বছরগুলোতে এর প্রকোপ খুব বেশি না হলেও ২০১৯ সালে তা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছর দেশে ডেঙ্গুতে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষাধিক মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক-বর্ষা মৌসুমের মশা জরিপে গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজধানীতে মশা বেশি দেখা গেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের একটি আশঙ্কা ছিল যে চলতি বছর আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রাজধানী ঢাকার। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাস মূল মৌসুম। চলতি বছরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার বর্ষাকালীন মশা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ১৩ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শুককীট পাওয়া গেছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে পাওয়া গেছে প্রায় ১২ শতাংশ বাড়িতে। জরিপে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে দক্ষিণ সিটির কমলাপুর, মতিঝিল, নবাবপুর, বংশাল, ওয়ারী ও নারিন্দা এলাকায়। আর উত্তর সিটির সেনপাড়া পর্বতা, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, বেগুনবাড়ি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও আগারগাঁওয়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপ বলছে, ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রাজধানীর ২৭টি ওয়ার্ড। জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সোর্স : মানব জমিন