রেলের মতোই বেহাল তাদের ১০টি বিদ্যালয়ের। সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হলেও এখানে নেই শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা। উন্নয়ন ফিরিস্তিতে সাফল্য হিসেবে দেখানো হলেও বিদ্যালয়গুলোতে ধীরে ধীরে কমানো হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। রেলের নতুন জনবল কাঠামোয় বিদ্যালয়গুলোকে অনুদান খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে সরকারি চাকরিজীবী হয়েও শিক্ষক-কর্মচারীরা তিন মাস বেতন পাচ্ছেন না।
১৯১৮ সাল থেকে বিদ্যালয় পরিচালনা করছে রেলওয়ে। ওই বছর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে রেলওয়ে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে পাকশীতেই হয় রেলওয়ে সরকারি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ। এরপর ১৯৭৩ সালের মধ্যে আরও আটটি রেলওয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো হলো- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ময়মনসিংহের রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সল্টগোলা রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকায় শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পাবনায় রেলওয়ে সরকারি নাজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, লালমনিরহাট রেলওয়ে সরকারি চিলড্রেন পার্ক উচ্চ বিদ্যালয় ও নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
সাধারণের মতোই রেলওয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিদ্যালয় চলে রেলওয়ের টাকায়। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয় রেলওয়ে। তবে তাঁরা বেতন-ভাতা পান আর দশটি সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীর সমান। কিন্তু এই টাকা দেয় রেলওয়ে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে রেলওয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা ছিলেন মহাপরিচালকের অধীন সংস্থাপন শাখার জনবল। কিন্তু গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর রেলের নতুন জনবল কাঠামোতে বদল এসেছে। বিদ্যালয় ও জনবল অনুদান শাখায় স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে সরকারি চাকরিজীবী হয়েও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। যদিও নতুন জনবল কাঠামো নিয়ে খোদ রেলেই বিতর্ক চলছে। আর্থিক নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা অর্থ ও হিসাব বিভাগকে রেলের মহাপরিচালকের অধীনে নেওয়া হয়েছে। একে আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি বলেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়।
রেলওয়ের পরিচালক (অর্থ) সোহেল আহমদ সমকালকে বলেছেন, রেলের সংস্থাপন শাখা জনবল কাঠামো তৈরি করেছে। বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ইন্টিগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সিস্টেম প্লাস প্লাস (আইবাস) থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন পান। নতুন জনবল কাঠামো শিক্ষকদের অনুদান খাতে স্থানান্তর করায়, বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। অনুদান খাত থেকে তাঁদের বেতন দিলেও ভবিষ্যতে পেনশন নিয়ে জটিলতা হবে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে জনবল কাঠামো কার্যকর হয়। তবে গত ১ জুলাই নতুন অর্থবছর শুরুর পর এ নিয়ে জটিলতা ধরা পড়ে। নতুন বছরের বাজেটে বরাদ্দ না থাকায় শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেছেন, তাঁকে জানানো হয়েছে জনবল কাঠামোতে ভুল হয়েছে। ভুলের কারণেই বিদ্যালয়গুলো অনুদান খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে। শিক্ষকদের বেতনভাতার জটিলতা নিরসনে চেষ্টা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। শিগগির সমাধান হবে।
রেলওয়ের লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রবীর বিশ্বাস সমকালকে জানান, তিন মাস বেতন না পেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা খুব কষ্টে আছেন। ঈদের উৎসব ভাতা পর্যন্ত পাননি। রেলমন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, রেলওয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি চাকরিজীবী। আইবাসের মাধ্যমে বেতন পাচ্ছেন বহু বছর। কেন তাঁদের আইবাস থেকে বাদ দেওয়া হবে? আইবাস থেকে বাদ পড়লে কেউ কী আর সরকারি চাকরিজীবী থাকেন?
রেলের বিদ্যালয়গুলো এককালে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। ধীরে ধীরে শিক্ষা কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে রেল। লালমনিরহাট বিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি বন্ধ হয়ে যায়। রেলের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ২৭৫ জন। প্রধান শিক্ষক জানান, ২০২১ সালে বিদ্যালয়ের ৬৮ জন এসএসসি পরীক্ষা দিলেও এবার তা দাঁড়িয়েছে ৩৮ জনে। বিদ্যালয়ের জনবল কাঠামোয় ১৯ শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র সাতজন।
সৈয়দপুর রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থা আরও করুণ। এখানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বন্ধ। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ৪৭৫ জন। শিক্ষক পাঁচজন। তাঁদের একজন প্রধান শিক্ষক; একজন খণ্ডকালীন। কোনো শিক্ষক ছুটিতে গেলে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ রানা জানান, ২০২১ সালে এসএসসিতে তাঁদের ৯২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৯ জন পাস করে। এবার পরীক্ষার্থী মাত্র ৭১।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ রেলওয়ে বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ঢাকা ও সল্টগোলার রেলওয়ে বিদ্যালয়ে রয়েছে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। জনবল কাঠামোয় এখানে ২৮ শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছেন অর্ধেক। সারাদেশে ১০টি বিদ্যালয়ে শিক্ষক ১১২ ও কর্মচারী আছেন মাত্র ৪১ জন।
রেলওয়ের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অন্যান্য সরকারি স্কুলে ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া শ্রেণি কক্ষ রয়েছে। রেল টাকা দিতে না পারায় আমাদের এখানে কিছুই নেই। শিক্ষার মান ও পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শিক্ষার্থী কমছে। রেলের উন্নয়নে ৫ বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও বিদ্যালয়ে তার ছিটেফোঁটা পড়েনি। হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হলেও শিক্ষার্থীরা বসার বেঞ্চ পর্যন্ত পাচ্ছে না।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষায় বিনিয়োগের চেয়ে রেলওয়ের আগ্রহ বেশি প্রকল্প কেনাকাটায়। ভারতীয় রেলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দেশের সেরা। মনোযোগ না দেওয়ায় রেলের মতো বিদ্যালয়গুলোও ডুবছে। তবে রেল সচিব বলেছেন, বিদ্যালয়ের বিষয়ে তাঁরা খুবই আন্তরিক।
সোর্স : সমকাল