এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা; বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মামলা হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ২০০৯ সাল থেকে ১৪ বছরে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হয়েছে দুই শতাধিক মামলা। তবে এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে শুধু ৪৫টির। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির অর্থদণ্ড হয়েছে ৫ হাজার টাকা।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, ভুল আইনে মামলা, সাক্ষী হাজিরের ব্যর্থতা ও তদন্তের গাফিলতিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার ছয়টি বিষয়ে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান ও দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের মামলাবিষয়ক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকায় দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির অভিযোগই বেশি। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ সালের বিভিন্ন ধারায় এসব মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস, বইপত্র কিংবা যান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভুয়া সনদ বানানো ও পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অপরাধ রয়েছে। এগুলো ঢাকার আদালতে বিচারাধীন। অন্যদিকে ডিজিটাল মাধ্যম (ডিভাইস ও অ্যাপস) ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কিছু মামলা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও করা হয়েছে। এ দুটি আইনে করা মামলাগুলো ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন।
এদিকে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায়ও মামলা করা হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষা আইনে। ঢাকার আদালতের দেওয়া এক রায়ে বলা হয়েছে, ‘ভুল আইনে মামলা করা হয়েছে’। অভিযোগপত্রে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় আবিদা নামে একজন ‘ভুয়া পরীক্ষার্থী’ ধরা পড়েন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩-এর ক ধারায় মামলা হয়। ওই মামলায় ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে রায় দেন ঢাকার আদালত। রায়ে বলা হয়, চাকরির পরীক্ষা, পাবলিক পরীক্ষা নয়। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান নেই।
জানা যায়, গত ১৪ বছরে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় শুধু মেহেদী শামীম নামে একজনকে জরিমানা করা হয়েছে। তিনি ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়্যারলেস অপারেটর পদের নিয়োগ পরীক্ষার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পরিচয় গোপন করে আতিকুর রহমান সেজে পরীক্ষায় অংশ নেন। পরে এ ঘটনায় করা মামলায় ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর এ মামলার রায়ে আসামিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে আসামির বিরুদ্ধে প্রতারণার (দ বিধির ৪১৯ ধারা) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর দোষ স্বীকার করায় আদালতের রায়ে আসামিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, ‘আইন সংশোধন না করলে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা দুরূহ। বলা যায়, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে যথাযথ আইনই নেই। যেটা আছে তাতে শাস্তি অনেক কম। এ জন্য বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। কারণ তদন্ত কর্মকর্তাকেও আইন অনুযায়ী তদন্ত করতে হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী অভিযোগপত্র দিয়ে থাকেন। প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের।’
পরে বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের নজরে দেওয়া হলে ঢাকা মহানগর আদালতের প্রধান কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, ‘মামলা দায়েরে দুর্বলতা থাকলে বিচার যথাযথ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার সাক্ষী দিতে যারা আসেন তারাও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় উল্টোপাল্টা বলেন। অর্থাৎ সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে বক্তব্য দেন সেটি কোনো কারণে তাঁরা আদালতে দেন না। আবার ভুল আইনেও কিছু কিছু মামলা হচ্ছে, যা আদালতের রায়েও এসেছে। এসব কারণে আইন থাকার পরও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।’ বিদ্যমান আইন সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সংসদে য?াঁরা আছেন তাঁদের বিষয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনটি সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান করা উচিত। কারণ প্রশ্ন ফাঁস ঘৃণ্য অপরাধ। এর ফলে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।’
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে করা মামলায় আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ৩০ জনের নামে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে সারাদেশে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে ওই বছরের ১৯ অক্টোবর মধ্যরাতে ঢাবির দুটি হলে অভিযান চালায় সিআইডি। ওইদিন আবদুল্লাহ আল মামুন ও মহিউদ্দিন রানা নামে ঢাবির দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের তথ্যে অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে মামলা করা হয়েছে।
সোর্স : সমকাল