শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আগামীতে যারা নেতৃত্ব দেবেন এবং প্রশাসনসহ সর্বস্তরে দেশ গড়ার কাজ করবেন তাদের শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়। এ জন্যই বলা হয় শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা। কিন্তু, এই প্রত্যাশাটা হতাশায় ডুবতে বসেছে। শিক্ষার নামে কুশিক্ষা এবং নীতি নৈতিকতাবিহীন শিক্ষার কারণে সুশিক্ষা পাচ্ছেন না কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের শিক্ষকের বিরুদ্ধে আসছে শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করা, ছাত্রী ধর্ষণ-নিপীড়ণ, আর্থিক কেলেঙ্কারি, গবেষণায় জালিয়াতি, প্রশ্নফাঁস, দলবাজীসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ। এতে ক্লাসে সুশিক্ষার অভাবে পথভ্রষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তৈরি হচ্ছে কিশোর অপরাধী। মাদক-গাঁজা, কিশোর অপরাধসহ নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা। শিক্ষার এই বেহাল অবস্থার কারণে শিক্ষকদের সমীহ করার বদলে উল্টো বিতর্কিত হচ্ছেন।
Adipolo
Adipolo
এমন চিত্র বাংলাদেশে ছিল না। শিক্ষকদের আবস্থান পিতা-মাতার পরেই ছিল। মানষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকরা আদরিনী ছিলেন। কিন্তু এখন বদলে গেছে সে চিত্র। অপ্রিয় হলেও সত্য যে পুজনীয়র বদলে অনেক শিক্ষক ধিকৃত হচ্ছেন অপকৃতি ও দলবাসির কারণে। প্রবীণ শিক্ষাবিদরা বলছেন, এক সময় সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত হতো শিক্ষকরা। শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ মানুষ সকলের চোখে শিক্ষকরাই ছিল আদর্শ। কিন্তু শিক্ষকরা এখন তাদের সেই মর্যাদা হারিয়েছে। কারণ হলো-ব্যক্তিগত নৈতিকতার অভাব, অর্থাৎ টাকার জন্য বা পদের জন্য লোভাতুর হয়ে পড়া। দ্বিতীয়ত: রাজনীতি, অথচ শিক্ষকদের রাজনীতি এক সময় ছিল জাতীয়ভিত্তিক, দেশ তাকিয়ে থাকতো শিক্ষকরা কী বলছেন। এখন শিক্ষকদের একটা অংশ আছেন সরকারি দলের সঙ্গে, আরেকটা বিরোধী দলের সঙ্গে। তারাও এখন রাজনীতিবিদদের মতো গলাবাজি, গালাগালি করেন। আর তৃতীয় কারণ হলো, সমাজের সার্বিক অবক্ষয়।
জানা যায়, বিগত দেড় থেকে দুই দশক ধরেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নৈতিক অবক্ষয়ের সংবাদ বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কাছে ছাত্রী নিপীড়ণ, ধর্ষণের শিকার হওয়া, কোচিং-প্রাইভেট না পড়লে নম্বর কমিয়ে দেয়া, হেনস্থা করা, আর্থিক অনিয়ম-জালিয়াতি, প্রশ্নফাঁসের সাথে সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অভিযোগ উঠছে। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে গত সপ্তাহেই কুড়িগ্রামের একটি স্কুলের শিক্ষকরা দিনাজপুর বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ করা তারাই সেটি ফাঁস করেছেন আর্থিক লোভে। এই ঘটনায় ৫ জন শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু শিক্ষকদের এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বলেছেন, দুর্ভাগ্য আমাদের শিক্ষককে অ্যারেস্ট না করে পারিনি। আমি কার ওপর বিশ্বাস করবো। প্রশ্নপত্র আনা নেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম তিনিই ফাঁস করলেন। কোথায় বিশ্বাস করবো? ছাত্ররা কী শিখবে? শিক্ষকদের তো আমরা শাসন করতে পারি না।
গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন হলিক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহা। আত্মহত্যার পেছনে অভিযোগ করা হয়, যেসব ছাত্রী হলিক্রসের শিক্ষক শোভন রোজারিওর কাছে উচ্চতর গণিতে পড়ে না, তাদের ফেল করিয়ে দেন। মাউশির তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদন দিয়েছে কঠিন প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি সঞ্চার করতেন ওই শিক্ষক, যা পরোক্ষভাবে তিনি প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করতেন বলে প্রমাণিত।
গত বৃহস্পতিবার নোয়াখালীতে স্কুলছাত্রী তাসনিয়া হোসেন আদিতার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরিবারের অভিযোগ ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় সাবেক গৃহশিক্ষক জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সারাদেশের কোথাও না কোথায় ছাত্রী নির্যাতন, নিপীড়ণ ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে। নিয়োগ পরীক্ষা, পাবলিক পরীক্ষাসহ যতগুলো পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাম এসেছে শিক্ষক জড়িত থাকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, একটা শিক্ষক দল দাঁড়িয়ে গেছে, যারা নানানভাবে পুরস্কৃত হতে চান, যারা শিক্ষকতাকে ধারণ করতে পারেননি। যাদের ভেতরে নানান ধরণের চিন্তাভাবনা, সাম্প্রদায়িকতাও আছে। শিক্ষকরা যদি ছাত্র-ছাত্রীকে মর্যাদা না দেয়, সম্মান না করে, তবে সেই সম্মান তারাও পাবে না। আমরা ধরে নেই যে, তারা আমাদের সম্মান করবে। আর শিক্ষকদের কাজ শ্রেণিকক্ষেই শেষ না, শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক হবে পারিবারিক বন্ধনের মতো।
আর্থিক অনিয়ম ও দলবাজীতেও পিছিয়ে নেই শিক্ষকরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে আর্থিক ও নিয়োগে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। পিছিয়ে নেই অন্যরাও।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ বলেন, দুর্নীতির একটা ভয়ংকর চক্র সারাদেশে। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা হলো আমরা যারা শুদ্ধাচরের কথা বলি তারাই ভয়ঙ্কর অসৎ। আমরা অনেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার হয়ে গেছি। ভাই (শিক্ষক) আপনার এতো আওয়ামী লীগার হওয়া দরকার কী? আপনি আপনার কাজ সুষ্ঠুমতো করেন। আমরা মুখে বলি কিন্তু নিজে বিশ্বাস করি না।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবক্ষেত্রেই এখন শিক্ষক নিয়োগ হয় দলীয় বিবেচনা কিংবা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। ফলে শিক্ষকরাও নিয়োগ পাওয়ার পর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে না দেখে বাণিজ্য হিসেবে কাজে লাগান।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, শিক্ষকরা প্রাথমিকের ইংরেজি পারে না। স্কুলে পাঠদান তাদের কাছে গৌণ। তারা হয়তো অন্য কাজ করছেন এর পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন। তাদের কাছ থেকে কি শিখবে শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন, শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মানকে প্রাধান্য দিলে এই সঙ্কট সমাধান হবে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ান। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাসে শুধু পড়ান না; তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, তত্ত্ব উদ্ভাবনা করেন, আবিস্কার করে দেশকে নতুন পথ দেখান, জাতিকে উচ্চতায় নেন। সে কারণেই ‘সেরাদের সেরা’রাই হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের আগে নিজ নিজ বিভাগে মেধা তালিকায় শীর্ষ থাকা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল, গবেষণা, প্রবন্ধ, প্রকাশনা এবং উচ্চতর ডিগ্রিকে মূল্যায়ন করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করার কথা। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন রীতিই অনুসরণ করা হয়। অথচ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, গবেষণায় চৌর্য্যবৃত্তির অভিযোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা নকল করার দায়ে ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েজন শিক্ষকের পদাবনতিও দেয়া হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষার মানের এই অবনমনের জন্য প্রধানত দায়ী শিক্ষকরা। শিক্ষা নেতৃত্বের সংকট। এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে হলে রাজনীতিবিদদের পিছনে ঘুরতে হয়। শিক্ষকরা পড়াবেন বা গবেষণা করবেন কখন? তারা তো রাজনীতিবিদদের পিছনে ঘুরেই সময় শেষ করে দেন। এখানে শিক্ষাবিদ হয়ে লাভ নেই। রাজনীতি করলে বড় পদ পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে পারছি না। ভালো শিক্ষক হলে ভালো ছাত্র তৈরি হবে। আমরা তো এখন জিপিএ ৫ নিয়ে উচ্ছ্বসিত। নিজেরা নিজেদের প্রশংসা করলে তো হবে না। আমাদের শিক্ষাকে বিশ্ব কিভাবে দেখে, তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইআর)-এর ড. মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিচিং ইউনিভার্সিটিতে পরিণত হয়েছে। শুধু পড়াচ্ছে। টার্গেট হলো শুধু বিসিএস। সরকারি চাকরি করবে। বিশ্ববিদ্যালয় কি সরকারি চাকরিজীবী বানাবার কারখানা? এটা কি ট্রেনিং সেন্টার? বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান চর্চা এবং নতুন জ্ঞানের সন্নিবেশ করার জায়গা। সেটা কিন্তু হচ্ছে না। সেটা কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। এখানে গবেষণা হয় না। এখানে হয় রাজনৈতিক দলাদলি।’
প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার প্রতি আগে মানুষের আগ্রহ ছিল। সেই সূত্রে শিক্ষকদের সম্মান করা হতো। এখন তা কমে গেছে। কেননা এখন টাকা আর রাজনৈতিক জোরেই অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। এর সমান্তরালে শিক্ষকদের প্রতিও আগ্রহ কমেছে।
তিনি বলেন, দেশের শিক্ষার মানে যে উন্নতি ঘটছে না, সেটা বাস্তবিক সত্য। গত কয়েক দশকে শিক্ষার আকার যেভাবে বেড়েছে, গুণগত মান সেভাবে বাড়েনি। আসলে শিক্ষার মান অনেকাংশেই নির্ভর করে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের ওপর। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের সনদ নিতে হয়। শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহন অত্যাবশ্যক। তাই আমাদের দেশেও নিয়োগের শর্ত হিসেবে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক হওয়াও জরুরি। কেননা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যাবে না।
তিনি বলেন, এখন পাবলিক স্কুল-কলেজে পড়াশোনা হয় না, শিক্ষার্থীদের যেতে হয় কোচিং সেন্টারে। আর সেখানে যাওয়া মানেই হচ্ছে শিক্ষা কেনা। শিক্ষার্থীরা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনছে , পরীক্ষায় ভালো ফল কেনার চেষ্টা করছে। চিকিৎসা যেমন করে কিনতে হচ্ছে, শিক্ষাও সেভাবে আমাদের কিনতে হচ্ছে।
সোর্স : ইনকিলাব