ড. মো. নূরুল আমিন
একটি মর্মান্তিক ঘটনা দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করছি। ঝিকরগাছার এক পিতা ভরণ পোষণ না পেয়ে তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন বলে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সোমবার ঝিকরগাছার বেনিয়ালী গ্রামের বৃদ্ধ আবদুল হক তার দু’ছেলে আসাদুজ্জামান আসাদ ও আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলা করেন এবং বিচারক জনাব আরমান হোসেন অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বৃদ্ধ আবদুল হকের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে আবুল কালাম আজাদ কৃষি কাজ এবং আসাদ চাকরি করেন। তিনি আসাদকে এম এ পাশ করানোর পর ব্যবসার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। বেনিয়ালী বাজারে বাড়িসহ বৃদ্ধ আবদুল হকের ২৬ শতক জমি ছিল। এই বাড়ি ও জমি তার দুই ছেলে তার কাছ থেকে লিখে নিয়েছিলেন। আজাদ বাড়িতে এবং আসাদ চাকরি উপলক্ষে সাতক্ষীরায় থাকে। কালাম জায়গা না দেয়ায় এতদিন বৃদ্ধ আবদুল হক বড় ছেলের ভাগের একটি কক্ষে থাকতেন। গত ২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা থেকে আসাদ বাড়ি এসে পিতাকে বের করে দিয়ে কক্ষে তালা লাগিয়ে দেয়। ছেলেরা পিতার ভরণ পোষণ ও ওষুধপত্র দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে তিনি বাজারের লোকজনের সহযোগিতায় অন্যের ঘরে থাকছেন এবং বাধ্য হয়ে ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ভরণ পোষণ, আবাসন ও চিকিৎসার জন্য পুত্রের বিরুদ্ধে পিতার মামলার ঘটনা হয়ত এটি প্রথম নয়। তবে মুসলিম সমাজের জন্য এটি অত্যন্তÍ বেদনাদায়ক। ইসলামী পারিবারিক আইনে পিতা মাতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং তাদের আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করাকে সর্বোত্তম মহৎ কাজ হিসেবে গণ্য করেছে।
ইসলাম পিতামাতার অবাধ্য হতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন বা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করো এবং বলো, হে আমাদের প্রতিপালক, তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”
এখানে আল্লাহ তার ইবাদত ও একত্ববাদের নির্দেশ দিয়ে সাথে সাথেই পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে সুরা লুকমানের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা উল্লেখ করার পরেই পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হবার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমার নিকটই।” সহিহ বুখারীতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞেস করলাম আল্লাহর কাছে কোন কাজটি সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, সময় মতো নামায আদায় করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। এই হাদিসটি মুসলিম শরিফেও রয়েছে।
হাদিসে পিতামাতার সদ্ব্যবহারকে জিহাদের আগে উল্লেখ করা হয়েছে, কেননা তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা ফরজে আইন, যা পালন করা একান্ত জরুরি এবং সে ব্যাপারে অন্য কোন কিছুই তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না।
আল্লাহর পথে জিহাদ করা ফরজে কিফায়া কিছু লোক তা পালন করলে অন্যরা তা থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়। অন্যদিকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার ফরজে আইন যা অধিক শক্তিশালী।
পবিত্র কুরআনে এমন কি বিধর্মী পিতামাতার প্রতিও সদ্ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুরা মুমতাহিনার ৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়িঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের নিষেধ করেন না। তিনি ন্যায়বিচারকারীদের পছন্দ করেন।
সুরা আন নিসার ৩৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং কোন কিছুকে তার শরীক করবে না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।” ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “সন্তান পিতামাতার সাথে কোমলতা ও নম্রতার মাধ্যমে সদাচরণ করবে। সে কোন কিছুর জবাবে কঠোরতা প্রকাশ করবে না, তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে না এবং তাদের সামনে কণ্ঠ উচ্চকিত করবে না (আল কাওয়াকিহুদ দাওয়ানী)।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত হলো কোনও ব্যক্তি তার পিতামাতাকে গালি দেয়া। অন্য এক বর্ণনায় আছে, কবিরা গুনাহসমূহের অন্যতম হলো কোন ব্যক্তির তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়া।
পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে আরো অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে। বৃদ্ধকালে তাদের ভরণ-পোষণ, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সন্তানের দায়িত্ব। এতে তাদের বাড়ি এবং পরিবার থেকে আলাদা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত এটা ইসলামেরই অনুপম ব্যবস্থা। বৃদ্ধকালে পিতামাতা শিশু হয়ে যায়। সদ্য প্রসূত শিশুকে যেমন নার্সিং করতে হয়, তেমনি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকেও নার্সিং করার প্রয়োজন পড়ে। ইসলামের পারিবারিক আইনে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। ঝিকরগাছার বৃদ্ধ পিতা আবদুল হক তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। অভিযুক্ত দুই ছেলের মধ্যে একজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। মাস্টার্স আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ডিগ্রি; ছেলেটিকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত বলা চলে। অন্য ছেলেটির শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। শিক্ষিত ছেলেটি কি করলো? তা মা সম্পর্কে মামলার বিবরণীতে কিছু বলা হয়নি। সম্ভবত তিনি বেঁচে নেই, থাকলে তার অবস্থাও ভালো হতো বলে মনে হয় না। পিতা-মাতা সন্তানের জন্মদাতা, তাদের প্রতি সন্তানের ঋণ অপরিসীম ও অপরিশোধযোগ্য। সন্তান গর্ভ অবস্থায় থাকাকাল থেকে শুরু করে তাদের শিশু, কিশোর ও যুবক অবস্থা পর্যন্ত ভরণ-পোষণ, পরিচর্যা, অসুখ-বিসুখ ও বাইরের বিপদাপদ থেকে তাদের রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব পিতামাতা বহন করেন। তারা যদি বৃদ্ধকালে পিতামাতার দুঃখ-দুর্গতির কারণ হন তাহলে আল্লাহ তা সহ্য করেন না। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি আখিরাত তো বটেই দুনিয়াতেই তারা তা পেয়ে যান। সন্তানের তরফ থেকে যত দুঃখ-কষ্টই আসুক না কেন পিতা-মাতা বদদোয়া করেন না। মামলার যে ঘটনাটি ঘটেছে তা এই অভাগা পিতার সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে বলেই ঘটেছে বলে মনে হয়, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো পাঠদানের ব্যবস্থা নেই। আমরা ছেলে-মেয়েদের যে শিক্ষায় শিক্ষিত করি তা ভোগবাদী দুনিয়ার চাহিদাই পূরণ করে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চাহিদা পূরণ করে না। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া নৈতিক শিক্ষা পাওয়ার উপায় নেই, উপরে আমি কুরআন হাদিসে বর্ণিত পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। আমাদের দেশের অন্য দু’টি ধর্ম-হিন্দু ও খৃস্টান ধর্মেও পিতামাতাকে শ্রদ্ধা ও সেবা করার কথা বলা হয়েছে।
হিন্দু ধর্মে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পিতার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হলেও মাতাকে নমশ্য বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘পিতা ধর্ম পিতা স্বর্গ, পিতাহি পরমংতপঃ প্রিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা’ তারা পঞ্চ পিতা সপ্ত মাতায় বিশ্বাস করে এবং পিতা ও মাতাসম ব্যক্তিদের সেবা শুশ্রুষার উপর স্বর্গ নির্ভর করে বলে মনে করে। অনুরূপভাবে খৃস্টান ধর্মের দৃষ্টিতেও পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব অবহেলা করা যায় না। বিশেষ করে যখন তারা বার্ধক্যে পৌঁছেন। টিয়াওয়াকার নামক একজন খৃস্টান ধর্ম/ বিশেষজ্ঞ ‘The Inspired Caregiver’ শীর্ষক একটি পুস্তকে বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি ১০টি নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছে-
১। শিশুকাপল পিতামাতা তোমাদের প্রতি যেমন যত্ন নিয়েছেন ঠিক তেমনি তারা বৃদ্ধকালে উপনীত হলে তোমরা তাদের যত্ন নাও এবং পরিচর্যা কর।
২। তাদের সাথে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ কর।
৩। তাদের সাথে বাচ্চা ছেলের মতো আচরণ করো না।
৪। তাদেরকে সময় দাও, গোপনে তাদের কাঁদতে দিও না।
৫। তাদের সুখ-দুঃখ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রশ্ন উঠলে তাদের পাশে দাঁড়াও।
৬। তাদের কাছ থেকে শিখ; বৃদ্ধরা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ (Old is gold)।
৭। দুনিয়ার অনেক পরিবর্তন হচ্ছে; পারলে তাদের নতুন টেকনোলজি শেখাও।
৮। বাড়িত থাকার ও বিচরণের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করো না।
৯। তাদের ইচ্ছা ও চাহিদাগুলোকে অবজ্ঞা করো না, সম্মান করো।
১০। তাদের প্রতি এমন আচরণ করো না যাতে তাদের মনে এ ধারণা জন্মাতে না পারে যে তাদের জামানা শেষ হয়ে গেছে।
ইসলামের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে আরো জানার জন্য বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্স এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত ইসলামের পারিবারিক আইন (আল-মাওস আতুল ফিকহিয়্যাহ) প্রথম ও দ্বিতীয় খ- পড়ার জন্য আমি পাঠক-পাঠিকাদের অনুরোধ করছি।
আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা আজ ভাঙনের মুখে। মামলা-মোকদ্দমা বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো দু’একটি সমস্যার সমাধান করবে কিন্তু সামগ্রিক সমস্যার সমাধান করতে হলে ব্যাপক শিক্ষা-প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা নেই। এটা যেমন মুসলমানদের বেলায় সত্য, তেমনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টানদের বেলায়ও সত্য। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে এর অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। বৃদ্ধ বয়সে অশিক্ষিত পিতা-মাতারাই শুধু নিগৃহীত হচ্ছে না, শিক্ষিত কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সিনিয়র আমলারাও হচ্ছেন। এ ব্যাপারে সোস্যাল মিডিয়ার ভাইরাল হওয়া রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল আওয়াল এবং একজন সাবেক আমলা ও অর্থমন্ত্রীর ঘটনাগুলো স্মরণ করা যেতে পারে। যতদিন এই শিক্ষা কারিকুলামভুক্ত না হচ্ছে ততদিন পিতা-মাতা হিসেবে শিশুকালে আমরা সন্তানদের এই নৈতিকতাগুলো শিক্ষা দিতে পারি, আমাদের দেশে দু’লক্ষাধিক মসজিদ আছে। প্রতি সপ্তাহে জুমার নামাযের আগে ইমাম সাহেবরা খুতবা দেন সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোকে যদি তারা খুতবার অন্তর্ভুক্ত করে নেন তাহলে সমাজের এই অপ্রত্যাশিত অবক্ষয় থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি বলে আমার বিশ^াস। পাশাপাশি সরকারকেও বৃদ্ধি পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩-এর কঠোর প্রয়োগের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম