আরাকানে যুদ্ধের বিস্তার
মিয়ানমারের মান্দালয়ে জান্তার প্রশাসককে বিদ্রোহীদের হত্যা
সাগাইংয়ে নিহত ব্যক্তির লাশ পুড়িয়েছে সেনারা
মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু,পালংখালীর পর এবার টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমান্তের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আরাকানে চলমান যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়েছে এবং উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে তীব্র লড়াই চলছে। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া থেকে কানজরপাড়া সীমান্তে মিয়ানমারের ভেতরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। থেমে থেমে গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকায় আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ মানুষ। গতকাল সোমবার ভোর থেকে মর্টার শেলের মতো ভারী অস্ত্রের গোলার শব্দে কেঁপে ওঠে হোয়াইক্যং উলুবনিয়ার খারাংখাঘোনা থেকে কানজরপাড়া এলাকা। থেমে থেমে গুলির শব্দ অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বিষয়টি নিশ্চিত করেন হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের উলুবনিয়া এলাকার হাজী জালাল আহমদ। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে তার ওয়ার্ড উলুবনিয়া সীমান্তে ভারী অস্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিকট শব্দে জেলেরা আতঙ্কিত হয়ে নাফ নদীসহ সীমান্ত এলাকায় কাজ করতে যাচ্ছে না। উলুবনিয়া থেকে টেকনাফের বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্রের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারও দেখা যায়।’ তিনি জানান, হোয়াইক্যংয়ের খারাংগাগুনা ও উলুবনিয়া গ্রামের ৪০০ পরিবারের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হোয়াইক্যংয়ের সীমান্ত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু জানান, গত কয়েক দিন ধরে ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে টেকনাফ সীমান্ত এলাকায়। সোমবারও গুলির শব্দ শোনা গেছে।
হোয়াইক্যং ইউপির চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী দাবি করেন, বান্দরবানের তুমব্রুর পর এবার টেকনাফ সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সীমান্তের দুই গ্রামে মানুষ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। আমরা তাদের খোঁজ রাখছি। এখানকার লোকজন ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছেন।
টেকনাফ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, এই সীমান্তে গোলাগুলির খবর জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জেনেছি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তের ৩০০ মিটারের ভেতরে বসবাসকারীদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের খোঁজখবর রাখছি।
টেকনাফ ২-বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা সজাগ রয়েছে বিজিবি। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছি। অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে আছে বিজিবি।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত মো: ইকবাল (১৭) নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হন। আহত হন পাঁচজন। একই দিন দুপুরে সীমান্ত এলাকা থেকে গরু আনতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে উইনু থোয়াইং তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজনের পায়ের নিম্নাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এ দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে গতকাল সোমবার কোনো গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউপি সদস্য মো: আলম। তিনি বলেন, রোববার থেকে গোলাগুলির শব্দ একটু কমেছে। যদিও সীমান্তের মানুষের মাঝে এখনো আতঙ্ক রয়েছে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের বাংলাদেশ অভ্যন্তরে মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি বুলেট এসে পড়ে। ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দু’টি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়ে। তার আগে ২৮ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা একটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তুমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে। এসব ঘটনায় তুমব্রু সীমান্তের মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়, যা এখনো কাটেনি।
মান্দালয়ে জান্তা–নিযুক্ত প্রশাসক নিহত : মিয়ানমারের মান্দালয় অঞ্চলের তৌংথা শহরে গত সপ্তাহে গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা সশস্ত্র এক জান্তা-নিযুক্ত প্রশাসককে গুলি করে হত্যা করে। টাংথা শহরের সাত মাইল উত্তর-পূর্বের হ্লেগু মা গ্রামে ৩৫ বছর বয়সী তুন অং কিয়াউকে গত ২১ সেপ্টেম্বর টিটিএ প্রতিরোধ যোদ্ধারা হত্যা করে। তার কাছে পাওয়া এম-২২ রাইফেল এবং গোলাবারুদ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
টিটিএর এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাউকে জানিয়েছেন যে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকেই হ্লেগু মা-এর প্রশাসক ছিলেন তুন অং কিয়াউ। যখন তার পরিচয় নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়েছিল তখন তিনি আক্রমণকারীদের খুব কাছ থেকে গুলি চালান। ওই কর্মকর্তার দাবি, তিনিই আক্রমণের সূচনা করেছিলেন, আমরা নই। কারণ কাছাকাছি শিশুরা ছিল। তিনি যে গুলি চালিয়েছিলেন তা শিশুদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। সব শিশু পালিয়ে যাওয়ার পর আমাদের সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করে। বন্দুকযুদ্ধে টিটিএর কোনো সদস্য আহত হয়নি বলে জানান তিনি। এ দিকে তুন অং কিয়া নিহতের কয়েক ঘণ্টা পর সামরিক বাহিনী আশপাশের গ্রাম থেকে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন স্থানীয়কে গ্রেফতার করে।
সাগাইংয়ে বেসামরিক ব্যক্তির লাশ পোড়াল সেনারা : গত সপ্তাহের শেষ দিকে সাগাইং অঞ্চলের মায়াং শহরতলির একটি গ্রামে অভিযানের সময় সেনাবাহিনী একজন বেসামরিক নাগরিক এবং স্থানীয় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) একজন সদস্যকে হত্যা করেছে। প্রতিরোধ বাহিনীর বরাতে মিয়ানমার নাউ জানায়, প্রায় ১০০ সৈন্যের অভিযানটি গত বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হয়। স্থানীয় প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর একটি জোট মায়াংয়ের সিভিল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি অর্গানাইজেশনের (সিডিএসওএম) মুখপাত্র নওয়ে ওও বলেন, অভিযানের পরের দিন নিহত দুইজনের লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমরা পিডিএফ সদস্যের লাশ আনতে পেরেছি; কিন্তু গ্রামের মাঝখানে থাকায় বেসামরিক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করতে পারিনি। সৈন্যরা চলে যাওয়ার সাথে সাথে এটি পুড়িয়ে দিয়েছে।
স্কুলে শিশু হত্যাকে যুদ্ধাপরাধ বলছে ঐক্য সরকার : সংবাদমাধ্যম দি ইরাবতী জানিয়েছে, মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) অভিযোগ করেছে, দেশটির ডেপাইন স্কুলে হত্যাকাণ্ড স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছে যে, জান্তা প্রকাশ্যে এবং ক্রমাগত আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধ করছে। প্রতিরোধের শক্ত ঘাঁটি সাগাইং অঞ্চলের দেপাইন শহরতলির লেট ইয়েট কোন গ্রামের একটি স্কুলে কয়েকদিন আগে বিমান হামলার সময় সাত শিশুসহ কমপক্ষে ১২ জন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। ঐক্য সরকারের মানবাধিকার মন্ত্রণালয় বলছে, মৃতদের মধ্যে একজনকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। কারণ তাদের দেহের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়েছে, ১০ নম্বর পরিদর্শন সদর দফতরের অধীনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্যাটালিয়ন ৩৬৮-এর সৈন্যরা এ অপরাধ ঘটায়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর এমআই-৩৫ সামরিক হেলিকপ্টার থেকে ওই স্কুলে গুলি চালানো হয়।
সোর্স : নয়া দিগন্ত