প্রবাসীদের আয়ের ওপর আবারো হাত
প্রতি ডলারে কমানো হলো ৫০ পয়সা
বলা হচ্ছিল মূল্য বেঁধে দেয়ায় রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাবে। আর এটাই ঘটছে বাস্তবে। গত ২২ দিনে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তা আগের মাসের একই সময়ের চেয়ে ১৮০ মিলিয়ন বা ১৮ কোটি ডলার কম। গত আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলার, সে হিসাবে মাসের প্রথম ২২ দিনে আসে ১৪৪ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর চলতি সেপ্টেম্বরের ২২ দিনে এসেছে ১২৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ তথ্য দেশের চলমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ও চাহিদার পরিস্থিতিতে মোটেও সুখবর না হলেও এটাই বাস্তবতা। এর পরেও রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য আরো কমানোর জন্য চাপ দেয়া হয় বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। গতকাল বাফেদার বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে প্রবাসীদের আয়ের ওপর আবারো হাত দেয়া হলো। এবার প্রবাসীদের অর্জিত প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা কমিয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে, যা দুই সপ্তাহ আগে নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০৮ টাকা। এর ফলে প্রবাসীদের নিট আয় কমে যাবে। বেড়ে যেতে পারে হুন্ডি প্রবণতা। এতে রেমিট্যান্সের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ডলারের সঙ্কট এখনো আছে। অনেকেই ডলারের সঙ্কটের কারণে আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারছে না। তিনি বলেন, মুদ্রার এ বিনিময় হার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা যাচ্ছে না। এ জন্য মুদ্রানীতিতে বিশেষ করে সুদহারের বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, প্রবাসী ও রফতানিকারকরা উভয়ই ডলার আহরণ করছে, কিন্তু মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য রাখা হয়েছে ৯ টাকা এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তিনি মনে করেন, এ কারণেই ডলারের অভিন্ন দর কার্যকর হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, ধীরে ধীরে রফতানিকারকদের ডলারের মূল্য বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে সুদহার দিয়ে টাকাকে সাপোর্ট দেয়া দরকার। অন্যথায় সরবরাহ পরিস্থিতি সহসাই উন্নতি হবে না বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য ব্যাপক হারে কমে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য কমানোর ফলে প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। এর ফলে কাক্সিক্ষত হারে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গতকাল বাফেদা ও এবিবি’র যৌথ বৈঠক সোনালী ব্যাংকে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ত্ব করেন বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আফজাল করিম। এ সময় এবিবির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এবিবি চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাফেদার চেয়ারম্যান মো: আফজাল করিম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দেশের স্বার্থেই বাফেদা ও এবিবি’র পক্ষ থেকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। আগে ডলারের মূল্য অস্থিতিশীল ছিল, এখন অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে আসছে। তিনি বলেন, বৈঠকে রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য ৫০ পয়সা কমিয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে, এক্সপোর্টের ডলারের মূল্য অপরিবর্তিত অর্থাৎ ৯৯ টাকা রাখা হয়েছে। এ দুই মূল্যের যে গড় হবে তার সাথে এক টাকা যুক্ত করে আমদানিতে লেনদেন হবে।
গতকাল বাফেদা সরবরাহকৃত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েব সাইটে আন্তঃব্যাংক ডলারের মূল্য দেখানো হয়েছে সর্বনিম্ন ১০৭ টাকা ৪০ পয়সা, সর্বোচ্চ মূল্যও একই দেখানো হয়েছে। এর সাথে এক টাকা যুক্ত করে ১০৮ টাকা ৪০ পয়সায় ডলার লেনদেন করা হয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আন্তঃব্যাংক ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা নামিয়ে আনা অনেক কঠিন হবে। কারণ, যে ব্যাংক রফতানি বিল বেশি নগদায়ন করতে পারছে ওই ব্যাংকের রেট কমে যাচ্ছে। কিন্তু যারা রফতানি বিল কম নগদায়ন করছে বিপরীতে রেমিট্যান্স আহরণ বেশি করছে তাদের রেট বেড়ে যাচ্ছে। এটা সমন্বয় না করা পর্যন্ত ডলারের একক দর কার্যকর করা সম্ভব হবে না। তাদের মতে, রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর আরো চাপ বেড়ে যাবে। এমনিতেই গতকাল একটি সরকারি ব্যাংকের কাছে কোনো ডলার বিক্রি করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ব্যাংকটির চাহিদিা ছিল প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়নের ঘরে নেমে আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরো সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এতে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর আরো চাপ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ৪ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫২২ মিলিয়ন ডলার, ১১ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ দিনে তা আরো কমে হয় ৪১২ মিলিয়ন ডলার, আর পরের পাঁচ দিন অর্থাৎ ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর রেমিট্যান্স-প্রবাহ আরো কমে হয় ২৫৬ মিলিয়ন ডলার। সবমিলে চলতি মাসের প্রথম ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৬৫ মিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের প্রথম ২২ দিনে গড়ে এসেছিল ১৪৪৪ মিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের এ চিত্র চলমান পরিস্থিতিতে মোটেও সুখকর নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, হুন্ডি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশী শ্রমের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় সরবরাহ পরিস্থিতি আরো খারাপ অবস্থানে চলে যাবে।
সোর্স : নয়া দিগন্ত