বিভিন্ন অভিযোগ এনে ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি)। সোমবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইএবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
আইএবির সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন এবং ড্যাপবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের আহ্বায়ক স্থপতি ইকবাল হাবিব সংবাদ সম্মেলনে ড্যাপের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করেন। তাদের মতে, এই ড্যাপ রাজধানীর ধনী শ্রেণিকে উপকৃত করলেও অন্যান্য এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া ফার বা ফ্লোর এরিয়া রেশিও নিয়ে বৈষম্য করা হয়েছে।
তবে ড্যাপের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপন করা অভিযোগ খণ্ডন করে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে সময়োপযোগী বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সরকার প্রণয়ন করেছে। সদ্য গেজেট হওয়া ড্যাপ সাধারণ মানুষসহ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শুধু উপকারই করবে না, একটি আধুনিক ও সুস্থ নগরী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেন ড্যাপের পরিচালক ও রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাধারণ মানুষকে উসকানি দিতে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এদিকে আইএবির সংবাদ সম্মেলনে ড্যাপবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের আহ্বায়ক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, যেখানে যে জমিতে ৮ তলা ভবন নির্মাণ করা যেত, সেখানে বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪-৬ তলা ভবন করা যাবে। তিনি অভিযোগ করেন, ঢাকা মহানগরীর মাত্র এক শতাংশ এলাকায় সর্বোচ্চ এফএআর (ভবনের মেঝের অনুপাত) দেওয়া হয়েছে, যার পরিমাণ ৫ থেকে ৬। তিনি ড্যাপ সংশোধন ও বাস্তবায়নে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বোর্ড পুনর্গঠনের দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘ড্যাপের কাঙ্ক্ষিত জনঘনত্ব ২০০ থেকে ২৫০ জন অনুযায়ী, ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ২০৩৫ সালে নেট আবাসিক জনঘনত্ব হবে ৩৯০ জন। অথচ ড্যাপের প্রাক্কলন অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি একরে মানুষ থাকবে ৫৩১ জন, যার মানে ১৪১ জন মানুষ আবাসন পরিকল্পনার বাইরে থাকবে।’
আইএবির স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘এ পরিকল্পনার লক্ষ্য ঢাকায় যারা আছে, তারা যেন সুস্থ-সুন্দরভাবে থাকতে পারে। কিন্তু ড্যাপ পর্যালোচনা করে আমরা দেখলাম, সবার আবাসনের কথা ভাবা হয়নি। যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে ঢাকা থেকে বহু লোককে চলে যেতে হবে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে কীভাবে বের করে দিতে হবে, কীভাবে চলে যেতে বলা হবে, সে প্রশ্নটি করতে চাই।’
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার সন্ধ্যায় ড্যাপের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি) থেকে যেসব দাবি করা হচ্ছে, তা আদৌ সত্য নয়। তারা বলছেন, রাজউক কর্তৃক প্রণীত ড্যাপ ২০২২-২০৩৫-এর প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহর থেকে নাকি প্রায় ৪০% মানুষকে চলে যেতে হবে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো-কেউ যাবে না। বরং যারা আছে, তারা আরও ভালোভাবে বসবাস করার সুযোগ পাবেন। রাজউক আওতাধীন ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিবিএস ২০১১ অনুযায়ী বর্তমানে জনসংখ্যা ১৫.৫১ মিলিয়ন বা দেড় কোটি, যা প্রায় দুই কোটি এবং ২০৩৫ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ধরা হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ; যা কোনোভাবে কম তো নয়ই, বরং ৬০ লাখের অতিরিক্ত মানুষ ঢাকা শহরে অভিগমন/সংযোজন হবে।
এছাড়া বর্তমানে ড্যাপের সুপারিশকৃত গড় ঘনত্ব অনুযায়ী রাজউক এলাকায় পরিণত অবস্থায় সর্বোচ্চ প্রায় ৬ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ ধারণ করা সম্ভব হবে। সুতরাং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা থেকে ৪০% মানুষকে বের হয়ে যেতে হবে-এরকম তথ্য একেবারেই সত্য নয়।
তারা মনে করেন, আবাসন যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশও মানুষের মৌলিক অধিকার। ফলে শুধু বড় ইমারত নির্মাণ কি মানুষের সেই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে পারবে বা পারছে? মনে হয় না।
২০০৮ সালের আগে ধানমন্ডি এলাকায় প্রতি বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটের মূল্য ছিল ২ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ কার্যকরের পর একই জমিতে দেড় থেকে দ্বিগুণের বেশি ফ্লোর নির্মাণের পরও বর্তমানে ফ্ল্যাটের মূল্য ১৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বরং বর্তমান ড্যাপে নিু ও নিুমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সুলভ আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই প্রথম ০.৭৫ প্রণোদনা ফার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেন মানুষ ক্রয়ক্ষমতার ভেতরে একটি ফ্ল্যাট কিনতে পারে।
এছাড়া ছোট জমির মালিকরা, যেমন ৩-৪ কাঠা, যদি উচ্চ এলাকাভিত্তিক ফার সংবলিত এলাকায় ও প্রশস্ত রাস্তার পাশে অবস্থিত হয়, তাহলে আগের ইমারত বিধির তুলনায়ও এই পরিকল্পনায় বেশি ফার তথা ফ্লোর স্পেস সুবিধা নিতে পারবে।
মিশ্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি রাস্তার প্রশস্তা ৮০ ফুট বা তদূর্ধ্ব হয়, যেখানে ১০০% বাণিজ্যিক স্থাপনা করতে পারবে। যেখানে ফার-এর মান আগের তুলনায় আরও বেশি।
বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানুষের অভিগমন এবং বসতি স্থাপন দ্রুততর হবে। এছাড়াও সাভার-গাজীপুর অঞ্চলে শিল্প ও সংশ্লিষ্ট ভূমি সদ্ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান আরও বাড়বে। সংগত কারণে এসব অঞ্চলে মূল ঢাকার চেয়ে তুলনামূলক জনসংখ্যা বাড়বে।
এমন বাস্তবতায় নতুন করে প্রণীত ড্যাপ পুরো ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য একটি সার্বিক ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা। এতে শুধু ইট-কাঠের দালান এবং ফার সুবিধা নয়, বরং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নাগরিক সুবিধাদি, অবকাঠামোসহ নানাবিধ প্রস্তাবনা রয়েছে। সুতরাং রাজউক যে কোনো ধরনের গঠনমূলক সমলোচনা ও পরামর্শকে স্বাগত জানায়। পাশাপাশি অসত্য তথ্যকে নিন্দা জানায়।
সোর্স : যুগান্তর