দেশে করোনার সংক্রমণ ও ডেঙ্গু আক্রান্ত সমান তালে চোখ রাঙাচ্ছে। উভয় রোগে বেড়েছে মৃত্যুও। এ অবস্থায় মানুষকে ফের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরাও ফের করোনা বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কয়েকদিন ধরেই করোনা সংক্রমণ বেশ ঊর্ধ্বমুখী। শনাক্তের হার ফের ১৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে। শনাক্তও ৭শ’র উপরে। একদিনে করোনায় আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। তাই মাস্ক পরা, হ্যান্ডওয়াশ করা এবং যারা ভ্যাকসিন নেননি তাদের দ্রুত ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ তাদের।
এদিকে, চলতি বছরে গতকাল ডেঙ্গুুতে রেকর্ড ৪৮২ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
একদিনে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত এবছর ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। বর্তমানে দেশে চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেশি। কারণ বহু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন না। আবার অনেক হাসপাতালও আছে যারা ডেঙ্গু রোগীর তথ্য অধিদপ্তরে পাঠান না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনা শনাক্তের হার বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে (১৯ থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ১৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ (১০ জন) লোক বিভিন্ন জটিল রোগে (কো-মরবিডিটি) ভুগছিলেন। অন্যদিকে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিলেন ৮ জন (৫৭ দশমিক ১ শতাংশ) এবং ভ্যাকসিন নেননি ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ (৬ জন)। মৃত ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন গ্রহণকারী ৮ জনের মধ্যে ৪ জন নিয়েছিলেন ২ ডোজ, ৩ জন নিয়েছিলেন বুস্টার ডোজ এবং একজন নিয়েছিলেন প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন।
ফের করোনা বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, মানুষ মাস্ক পরছে না। হ্যান্ডওয়াশও দেখছি না। ভ্যাকসিন নেয়ার প্রতিও অনীহা রয়েছে। এসব কারণে ফের করোনা বাড়ছে। করোনার সংক্রমণ বাড়ার গতিকে উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন। এই ভাইরোলজিস্ট করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী আচরণকে আরেকটি ঢেউ বলে অভিমত দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, পরামর্শক কমিটি কিছু সুপারিশ দিয়েছে। তা বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। যারা এখনো ভ্যাকসিন নেননি তাদের দ্রুত ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ দেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ।
ফের করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মানবজমিনকে বলেন, যেভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে তাতে একে নতুন আরেকটি ঢেউ বলা যায়। করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী আচরণকে দমনে সরকারের কৌশল নিতে হবে। এখন এই সীমিত সংখ্যক যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের কন্ট্রাকট্রেসিং করা দরকার। তাদেরকে এন্টিজেন্ট ও পিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে। যারা শনাক্ত হবেন তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আইসোলেশনে চিকিৎসা দিতে হবে। এই জনস্বাস্থ্যবিধ আরও বলেন, জনগণকে সঠিকভাবে সঠিক মাস্ক পরতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে উদ্বুদ্ধ এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যারা টিকা নেননি তাদেরকে দ্রুত টিকা নিতে হবে। যারা এখনো বুস্টার ডোজ নেননি তাদেরকে এই ডোজ দ্রুত নিতে হবে। আর যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন তাদেরকে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উপজেলা হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। এখানে জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি উপজেলায় হাসপাতাল শক্তিশালী করতে পারলে মহামারি এবং অতিমহামারি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, করোনা নিয়ে অবহেলা হচ্ছে। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সুপারিশ দিচ্ছেন, তা বাস্তবায়নে ঢিলাঢালাভাব দেখা যাচ্ছে। এই জনস্বাস্থ্যবিদ বর্তমান করোনার ঊর্ধ্বমুখী আচরণকে করোনার ষষ্ঠ ঢেউ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে বলেন, হাসপাতাল থেকে করোনা বেশি ছড়াচ্ছে। আমাদেরকে দূরত্ব মানাতে কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা মাস্ক পরা ভুলে গেছি। বাজারে বিপণি বিতানে, গণপরিবহনে কোথায় মাস্ক পরছে না। ডা. মুস্তাক হোসেন আরও বলেন, করোনার টেস্টও কম হচ্ছে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে টেস্ট করানো প্রয়োজন বলে তিনি পরামর্শ দেন। পাশাপাশি যারা এখনো ভ্যাকসিন নেননি তাদেরকে দ্রুত ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
করোনায় আরও ৬ জনের মৃত্যু: গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯ হাজার ৩৫৯ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন করে ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৫৭২ জন। ৭১৮ জনের মধ্যে রাজধানীতেই ৫৭৩ জন শনাক্ত হয়েছেন। নতুন শনাক্ত নিয়ে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ২০ লাখ ২২ হাজার ৪০৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ পৌঁছেছে। আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, দেশে ৮৮১টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ২৬২টি নমুনা সংগ্রহ এবং ৫ হাজার ২৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৪৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় পুরুষ ৩ জন এবং নারী ৩ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে ২ জন ঢাকা বিভাগের, একজন চট্টগ্রাম বিভাগে, একজন রাজশাহী বিভাগে এবং ২ জন বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা। সবই সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন। দেশে মোট পুরুষ মারা গেছেন ১৮ হাজার ৭৪০ জন এবং নারী ১০ হাজার ৬১৯ জন। নতুন শনাক্তের মধ্যে ঢাকা মহানগরের রয়েছেন ৫৭৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে রয়েছেন ৬০৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩১ জন, রংপুর বিভাগে শূন্য, খুলনা বিভাগে শূন্য, বরিশাল বিভাগে শূন্য এবং সিলেট বিভাগে ১০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
ডেঙ্গুতে রেকর্ড ৪৮২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি: দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়েই চলছে। চলতি বছরে গতকাল রেকর্ড ৪৮২ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একদিনে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে দেশে চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। চলতি মাসে গত মাসের চেয়ে দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী বেশি আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ বহু রোগী আছেন যারা হাসপাতালে ভর্তি হন না। আবার অনেক হাসপাতালও আছে যারা ডেঙ্গু রোগীর তথ্য অধিদপ্তরে পাঠান না।
ডেঙ্গুর প্রকোপ কখন কমতে পারে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, আগামী অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডেঙ্গুর উপদ্রব থাকবে। তবে তা নির্ভর করছে বৃষ্টি কমার উপর। শীত আসলে আস্তে আস্তে কমে আসবে। তিনি বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। মাঝে মাঝে যেসব অভিযান দেখি তা লোক দেখানো। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪৮২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৯২ জনে। এ মাসে ৮ হাজার ১৮১ জন আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আগস্টে ছিল ৩ হাজার ৫২১ জন। ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি মাসেই মারা গেছেন ৩২ জন। যা আগস্ট মাসে ছিল ১১ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৮২ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩২৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ১৫৪ জন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১২৩ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইতে ১ হাজার ৫৭১ জন এবং আগস্ট মাসে তা বেড়ে ৩ হাজার ৫২১ জনে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরের এই ২৬ দিনে আক্রান্ত হয়ে ৮ হাজার ১৮১ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৩২ জন। ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জুনে ১ জন, জুলাইতে ৯ জন এবং আগস্টে ১১ জন।
ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে আসে এডিস মশার মাধ্যমে। বর্ষায় বাসাবাড়িতে পানি জমে এই মশার বংশবিস্তার বেশি ঘটে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার বর্ষাকালীন মশা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রাজধানীর ২৭টি ওয়ার্ড। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ১৩ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শুককীট পাওয়া গেছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে পাওয়া গেছে প্রায় ১২ শতাংশ বাড়িতে। জরিপে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে দক্ষিণ সিটির কমলাপুর, মতিঝিল, নবাবপুর, বংশাল, ওয়ারী ও নারিন্দা এলাকায়। আর উত্তর সিটির সেনপাড়া পর্বতা, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, বেগুনবাড়ি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও আগারগাঁওয়ে।
সোর্স : মানব জমিন