সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন ও যানবাহন ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ১৩০টি জিপ গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে যানবাহন অধিদপ্তর।
এর মধ্যে বিভাগীয় ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারদের জন্য নতুন ৩০টি এবং বাকি একশটি হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য। যদিও এসব কর্মকর্তার ব্যবহৃত বর্তমান অনেক গাড়ির আয়ুষ্কাল এখনো শেষ হয়নি।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গাড়ি কেনাকাটার জন্য সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের বাজেট থেকে প্রায় ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে গাড়ি কেনার প্রস্তাবটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে উত্থাপন করেছে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর।
এর আগে নির্বাচন কমিশন আওতাধীন মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের জন্য ২৯টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয় অর্থ বিভাগের কাছে। এরমধ্যে ১৯টি সিনিয়র জেলা এবং ১০টি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা কার্যালয়ের জন্য। কিন্তু অর্থ বিভাগ ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চলতি বাজেট থেকে এখন পর্যন্ত নতুন বা প্রতিস্থাপক হিসাবে সরকারি কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার যানবাহন কেনাকাটার জন্য কোনো অর্থছাড় করা হয়নি। কারণ অর্থ সাশ্রয়ের জন্য এ বছর বাজেটের কতিপয় ব্যয় হ্রাস এবং স্থগিত করা হয়েছে। ওই সিদ্ধান্তের মধ্যে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় বন্ধ আছে।
জানতে চাইলে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহণ কমিশনার মো. আবদুস সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, ৪ অর্থবছর ধরে নতুন কোনো গাড়ি কেনা হয়নি। ফলে আগে কেনা অনেক গাড়ির আয়ুষ্কাল প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন অনেক বিকল্প ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যানবাহন সেবা নেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে বছরে ৫০টি গাড়ি কেনা হলে অন্তত ২০০ গাড়ি যুক্ত হতো। তিনি আরও বলেন, গত বছরে গাড়ি কেনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর একটি নীতিগত অনুমোদন ছিল। কিন্তু গত বছরেও কোনো অর্থব্যয় করা হয়নি গাড়ি কেনার পেছনে। সে অর্থ চলতি অর্থবছরে ব্যয় করা যাবে কিনা, সেটির ওপরও মতামত চাওয়া হয়েছে।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গাড়ি কেনার জন্য প্রথমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দুটি পৃথক প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাব দুটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অর্থ বিভাগের কাছে বিবেচনার জন্য পাঠায়। ওই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গাড়ি কেনার জন্য সরকারি সড়ক পরিবহণের কোডে মোটরযান কেনার জন্য একশ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এই বরাদ্দ অর্থ থেকে ইউএনওদের জন্য প্রতিস্থাপক হিসাবে একশ ‘এএসএক্স’ জিপ গাড়ি কেনা প্রয়োজন।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ২০০৬-০৭ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৪৮৪টি জিপ গাড়ি কেনা হয়। এর মধ্যে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কেনা হয় ৪৭টি, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কেনা হয় ২০৮টি। এছাড়া ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৯৮টি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ২টি, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯টি গাড়ি কেনা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য। প্রস্তাবে বলা হয়, এসব গাড়ি ব্যবহারের বয়স ১০ বছর থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত হয়েছে।
এস্টাবলিশমেন্ট ম্যানুয়াল (ভলিয়ম-২) এর পৃষ্ঠা নং-৫৬৭, এর-১ বিধি মোতাবেক গাড়িগুলোর আয়ষ্কুাল কাল অতিক্রম হয়েছে। এসব গাড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী। এ অনুপযোগী গাড়িগুলোর মধ্যে প্রতিস্থাপক হিসাবে গত ৩ অর্থবছরে মোট ১২৫টি গাড়ি কেনা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কেনা হয়েছিল ৯টি জিপ গাড়ি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৬টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে কেনা হয় ৫০টি গাড়ি। এখন ৩৫৯টি আধুনিক গাড়ি কেনার প্রয়োজন বলে ওই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লিখিত গাড়িগুলো প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মাধ্যমে মিৎসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট ‘কিউএক্স’ জিপ। যার প্রতিটি ৯৪ লাখ টাকা হিসাবে ক্রয় করা হয়। এরই মধ্যে মূল্য বেড়ে ‘কিউএক্স’ জিপ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে বর্তমান মূল্যে একশ গাড়ি ক্রয় করতে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ১৪৬ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে মিৎসুবিশির ‘এএসএক্স’ জিপ কেনার প্রস্তাব করেছে যানবাহন অধিদপ্তর। কারণ ‘এএসএক্স’ জিপের বর্তমান মূল্য ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এতে সরকারের একশ গাড়ি কিনলে ব্যয় হবে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। সেখানে কিউএক্স জিপ গাড়ির পরিবর্তে কম মূল্যে এএসএক্স কেনার নীতিগত অনুমোদন এবং চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) অধিদপ্তরের অনুকূলে যানবাহন ক্রয় খাতে বরাদ্দ একশ কোটি টাকা থেকে এ ব্যয় করার অনুমোদন চাওয়া হয়।
এদিকে অপর প্রস্তাবে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর বলেছে, বিভাগীয় ও অতিরিক্ত কমিশনারদের ব্যবহারের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিকমানের যানবাহন নেই। ফলে পরিবহণ সেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়া বিভাগীয় কমিশনারদের যে ৩৭টি গাড়ি দেওয়া হয়েছে, তা অন্যান্য অফিসের সমতুল্য নয়। কিন্তু এসব গাড়ির মধ্যে ২০২০ সালে কেনা হয় ১টি, ২০১৯ সালে কেনা হয় ১টি এবং ২০১৭ সালে কেনা হয়েছিল ৯টি গাড়ি।
এছাড়া ২০১৬ সালে কেনা হয় ১২টি গাড়ি, ২০১৫ সালে ২টি ও ২০১৪ সালে ৩টি কেনা হয়। আরও দেখা গেছে, এসব গাড়ির মধ্যে ২০১৩ সালে কেনা হয়েছিল ৬টি, ২০১১ সালে ১টি এবং ২০০৯ সালে কেনা ছিল ১টি। এসব গাড়ির মধ্যে মাত্র ৯টির আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে। বাকি ২৮টি গাড়ি সর্বনিু ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এসব গাড়ির ব্যাপারে প্রস্তাবে বলা হয়েছে জরাজীর্ণ।
আর জনপ্রশাসনের কাজের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে বরাদ্দ রাখা অর্থ দিয়ে ৩০টি জিপ গাড়ি কেনা প্রয়োজন। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। ওই প্রস্তাবে বিভাগীয় ও অতিরিক্ত কমিশনারদের জন্য ৩০টি কিউএক্স জিপ গাড়ি কেনাসহ অর্থব্যয়ের অনুমোদন চাওয়া হয় অর্থ বিভাগের কাছে।
যানবাহন ক্রয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা : যানবাহন কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ৩ জুলাই অর্থ বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সেখানে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনের লক্ষ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে কতিপয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থব্যয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে নতুন/প্রতিস্থাপক হিসাবে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় (মোটরযান, জলযান, আকাশযান) বন্ধ থাকবে।
সোর্স : যুগান্তর