এবারের বাজেটে নতুন করদাতাদের রিটার্ন জমায় বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত করদাতাদের যেখানে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা আছে, সেখানে নতুন করদাতারা আগামী ৩০ জুনের মধ্যে যে কোনোদিন চাইলে রিটার্ন দিতে পারবেন।
এতে অনেক করদাতা উৎসাহিত হলেও বিপত্তি বেধেছে জরিমানা নিয়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারীকৃত আয়কর পরিপত্রে বিষয়টি স্পষ্ট না করায় মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তারা দ্বিধায় পড়েছেন।
বর্তমানে প্রায় ৭৮ লাখ (৩১ মে পর্যন্ত) টিআইএনধারী আছেন। সরকারি-বেসরকারি সেবা নিতে তারা টিআইএন নিয়েছেন। কিন্তু এদের মধ্যে রিটার্ন জমা দেন ২৫ লাখের মতো। চলতি বাজেটে এ ধরনের করদাতাদের রিটার্ন জমায় উৎসাহিত করতে ‘ট্যাক্স ডে’-এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সেবায় টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা দিতে এসএমএস ও ই-মেইলে জানিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে বাধ্য হয়েই অনেকে রিটার্ন জমা দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু জরিমানার ভয়ে অনেকেই রিটার্ন দিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছেন।
করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন জমা দিলে জরিমানা, সরল সুদ ও বিলম্ব সুদ আরোপের বিধান রয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪ ধারায় বলা আছে, করদাতা যদি কোনো কারণ ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে রিটার্ন দাখিল না করেন, আবার এজন্য অনুমোদনও না নেন, সেজন্য তার পূর্ববর্তী বছর প্রদেয় করের ১০ শতাংশ বা ১ হাজার টাকার মধ্যে যেটি বড় অঙ্ক, ওই পরিমাণ অর্থ জরিমানা হবে। সেই সঙ্গে যতদিন দেরি হবে, প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে।
এবারের বাজেটে আয়কর আইনে যত পরিবর্তন আনা হয়, পরিপত্রের মাধ্যমে সেগুলোর ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা হয়। পরিপত্রে বলা হয়েছে, নতুন করদাতারা ৩০ জুন পর্যন্ত যে কোনোদিন সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। তবে আগে টিআইএন নিয়েছেন, করযোগ্য আয় ছিল, কিন্তু রিটার্ন জমা দেননি-এমন করদাতারাও একসঙ্গে বিগত বছরের রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে চলতি করবর্ষের (২০২২-২৩) রিটার্ন সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে জমা দেওয়া যাবে। আর বিগত করবর্ষের রিটার্ন সাধারণ পদ্ধতিতে জমা দিতে হবে। এখানেই যত বিপত্তি! সাধারণ পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা দিলে নিয়ম অনুযায়ী সেই রিটার্ন অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। অর্থাৎ রিটার্নে ঘোষিত করদাতা আয়-ব্যয়ের তথ্য, জীবনযাত্রার মান ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের সঠিকতা যাচাই করা হয়। উপকর কমিশনার করদাতার কাগজপত্র যাচাই করে দেখতে পান, করদাতার আগেই রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল; কিন্তু রিটার্ন জমা দেননি। সেক্ষেত্রে কর কর্মকর্তার জরিমানা করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, নুসরাত জাহান একজন গৃহিণী। তার ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও সঞ্চয়পত্র কেনা আছে। এসব কেনার প্রয়োজনে ২০১৯ সালে একটি টিআইএন নিয়েছিলেন; কিন্তু রিটার্ন জমা দেননি। এবার যেহেতু ব্যাংক তাকে রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা দিতে বলেছে, তাই রিটার্ন জমা দিয়েছেন। রিটার্ন যাচাই করে দেখা গেল, করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও তিনি রিটার্ন জমা দেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর কর্মকর্তা নোটিশের মাধ্যমে বিগত দিনের রিটার্ন জমা দিতে বলেছেন। সে অনুযায়ী রিটার্ন জমা দেওয়ার পর তাকে জরিমানা করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠপর্যায়ের একাধিক কর কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নতুন করদাতাদের রিটার্ন জমার বিষয়ে এবারের পরিপত্রে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এ ধরনের করদাতাদের জরিমানা করা হবে নাকি জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন নিষ্পত্তি করা হবে, তা নিয়ে একেক কর অঞ্চলে একেক ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। অনেক করদাতা আসছেন যারা রিটার্ন দিতে চাইছেন; কিন্তু জরিমানার কথা শুনে তারা আঁতকে ?উঠছেন। এর মধ্যে মহিলা করদাতাদের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া কর কর্মকর্তারাও এ ধরনের কেস সুরাহা করতে বিব্রতবোধ করছেন।
এ বিষয়ে গোল্ডেন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও আয়কর উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আইনে জরিমানার বিধান থাকলেও নতুন করদাতাদের রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে সেই জরিমানা আদায় করা হবে কি না, সেটি পরিপত্রে স্পষ্ট করা হয়নি। এতে করদাতাদের অনেকে দুশ্চিন্তায় আছেন। বিষয়টি স্পষ্ট করে এনবিআর একটি ব্যাখ্যা বা দিকনির্দেশনা জারি করতে পারে।
ঢাকা ট্যাকসেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুফী মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, এ বিষয়ে এনবিআরের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া খুবই জরুরি। কোথাও নতুন করদাতাদের রিটার্ন জমায় জরিমানা নিচ্ছে না, আবার কোথাও আইনজীবীদের ব্যাখ্যা মানা হচ্ছে না।
রিটার্ন জমা না দিলে যা হবে : এবারের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি ৩৮ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আগে এসব সেবা পেতে শুধু টিআইএন সনদ দিলেই হতো। যেহেতু প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাই সেবা পেতে রিটার্ন জমা দিতেই হবে। ব্যাংক হিসাব খোলা, ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র কেনা, ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, জমি কেনাবেচা, বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া, আমদানি-রপ্তানি সনদ নিতে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র লাগবে। এছাড়া ব্যাংকে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা না দিলে সুদ আয়ের ওপর বাড়তি উৎসে কর কাটা হবে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বা ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা না দিলে ১৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে।
সোর্স : যুগান্তর