নাছির উদ্দিন শোয়েব: মিয়ানমার সেনাবাহিনী একদিনের বিরতির পর তুমব্রু সীমান্তে আবারো ব্যাপক গুলী ছুঁড়েছে বলে জানা গেছে। বুধবার বিরতি দিয়ে বৃহস্পতি ও গতকাল শুক্রবার আবারও গুলী ছুঁড়ছে মিয়ানমার সেনারা। অপরদিকে আরাকান আর্মির সদস্যরাও থেমে নেই। তারাও সেনা সদস্যদের প্রতি পাল্টা গুলী ছুঁড়েছে। এতে তুমব্রু সীমান্ত এলাকা আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সীমান্তের ওপারে গুলীর বিকট শব্দে কাঁপছে এপারও। তাতে আতঙ্কে কোনারপাড়ার পার্শ্ববর্তী শূন্যরেখার (নো ম্যানস ল্যান্ড) আশ্রয়শিবিরে থাকা চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা এবং ঘুমধুম ইউনিয়নের কয়েক হাজার বাংলাদেশি। নিরাপত্তার খোঁজে সীমান্তে জড় হচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা মুসলিম। তারা যে কোনো সময় জীবন বাঁচাতে চলে আসতে পারে বাংলাদেশে। তবে ওপারের গোলাগুলীর ঘটনা নজরদারিতে রাখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েকশ রাউন্ড গুলী এবং শতাধিক মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। এছাড়া গতকাল ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়ার একাধিক সীমান্ত পয়েন্টের ওপারে মিয়ানমারে প্রচ- গোলাগুলীর শব্দ পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকার একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ঢেঁকিবুনিয়া ও তুমব্রু ঘাঁটিতে স্টকে গোলাবারুদ বাড়িয়ে মিয়ানমার বাহিনী আবারো গুলী ছুঁড়েছে।
বুধবার গোলাগুলীর শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে সন্ধ্যার পর মংডু থেকে গাড়িভর্তি গোলাবারুদ নিয়ে আসার পর রাত ১১টা থেকে সীমান্তে ফের গোলাগুলী শুরু করে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। এতে থেমে থাকেনি আরাকান আর্মির সদস্যরাও। এ অবস্থার কারণে সীমান্ত অধিবাসীরা রাতের ঘুমাতে পারছেন না। তারা উৎকণ্ঠায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুমের একজন শিক্ষকসহ আরও অনেকে। তুমব্রু সীমান্তের অধিবাসীরা আরো জানান, তারা ধারণা করেছিল বুধবার একদিন শান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সীমান্তে হয়ত শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই গুলাগুলী থামছে না। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের তিন নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলম বলেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার গোলাগুলী বেশি। এ কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তবে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি থাকা লোকজনকে এখনো সরিয়ে নেওয়া হয়নি। অগের কয়েক দিনের চেয়ে মিয়ানমারে এদিনের গোলাগুলী বেশি হয়েছে বলে জানান তমব্রুর বাসিন্দা মাহামুদুল হাসান। তিনি বলেন, অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশি গোলাগুলীর শব্দ শুনেছি। বাড়িঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। বিশেষ করে সকালে বেশি বিকট শব্দ শুনেছি। ওপারে কী অবস্থা বুঝা যাচ্ছে না, ভয় হচ্ছে কখন কী হয়। একই গ্রামের মোঃ ইমাম হোসেন বলেন, আগে তমব্রু বাজারের দোকানপাট ১১টার দিকে বন্ধ হতো। এখন এশার আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ দোকান বন্ধ করে চলে যায়। বৃহস্পতিবার স্কুলগুলোও বন্ধ ছিল। মিয়ানমারে গোলাগুলী বাড়ায় ভয়ে সীমান্তঘেঁষা নিজের চাষের জমিতে যেতে পারছেন না বলে জানান তমব্রু মধ্যমপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, ভয় লাগলেও কী করব? কিছু করে তো খেতে হবে। কয়েক দিন ধরে গোলাগুলীর কারণে নিজের চাষের জমিতে যেতে পারছি না। আমার মতো সীমান্তের কাছাকাছি ক্ষেতখামারে যেতে পারছে না আরও অনেক কৃষক। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সকাল থেকে আবারও থেমে থেমে গোলাগুলীর শব্দ ভেসে আসছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, নতুন করে রোহিঙ্গাদের স্রোত আসার আশঙ্কায় মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা সুরক্ষিত করেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী বেসামরিক নেত্রী অং সান সুকি-কে গ্রেফতার করার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে এক বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গত বুধবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা (সম্ভাব্য রোহিঙ্গাদের স্রোত ঠেকাতে) আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত করেছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের কিছু বন্ধু-রাষ্ট্র আশঙ্কা করছে যে, (সেনাবাহিনী মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করায়) সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে। মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার চলমান প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির লক্ষ্যে ঢাকা মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চায়। গত ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের সচিব পর্যায়ের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর করার ব্যাপারে আরো আলোচনার জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাংলাদেশে আর কোনো রোঙ্গিাকে স্থান দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে সীশান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেছেন, নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে কঠোর নজরদারি করছে প্রশাসন। মিয়ানমার থেকে আর কোনো রোহিঙ্গা যাতে আমাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারি করছে, আর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও সর্বোচ্চ সর্তকাবস্থায় কাজ করছে। জেলা প্রশাসক তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সীমান্ত নিয়ে আরও বলেন, সম্প্রতি আমি সীমান্তের পরিস্থিতি পরিদর্শনের জন্য ঘুমধুম, তুমব্রু ও নোম্যান্স ল্যান্ডে ঘুরে এসেছি।
উল্লেখ্য, গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ঘুমধুম এলাকার জনবসতিতে দুটি মর্টারশেল এসে পড়ে। এতে কেউ হতাহত না হলেও সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই থেমে থেমে গোলাগুলীর শব্দ শোনা যায়। এরমধ্যে দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করে দেশটি। এসব ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তিনবার তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে যাবে বলেও তখন হুঁশিয়ারি দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কিন্তু গত শুক্রবার মর্টারশেল ও ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে হতাহতের পর উদ্বেগ বেড়ে যায়। এ ঘটনায় এক মাসে চতুর্থবারের মতো গত রোববার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম