মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: বর্তমানে অস্থিরতা বিরাজ করছে ডলারের বাজারে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। টাকার মান পতনের কারণে পাহাড়সম হচ্ছে বিদেশী ঋণের বোঝা। গত এক বছরে বিদেশী ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ঋণ পরিশোধের পরিমাণও কমেছে। এ সময়ে ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত বছরের একই সময়ে সুদ-আসল বাবদ ২৯ কোটি ৮২ লাখ ২০ হাজার ডলার শোধ করা হয়েছিল। এ হিসাবে এই দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ প্রায় ৩ শতাংশ বেশি অর্থ শোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
অন্যদিকে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থা ও দেশগুলোর অর্থ ছাড়ের পরিমাণ কমেছে। জুলাই ও আগস্ট মাসে বৈদেশিক অর্থছাড় কমেছে ৮৬ দশমিক ৪২ কোটি মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৪ দশমিক ২৯ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে একই সময়ে ২৭ দশমিক ৮৭ বা ২৮ কোটি মার্কিন ডলার ঋণছাড় কমেছে। এই সময়ে দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ৮৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের এই দুই মাসে ১১৪ কোটি ২৯ লাখ (১.১৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা।
ঋণের বোঝা বাড়ার কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে টাকার মান কমে যাওয়া। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত বুধবার টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা। অর্থাৎ ১ ডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা। এক বছর আগে ২১ সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ২৭ পয়সা। ডলারের বিপরীতে টাকার বিশাল এই পতন দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর জানান, ডলারের এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন আমাদের অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমদানি কমছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। কিন্তু ডরারের দর কমছে না; এরই মধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। আমাদের বিদেশী ঋণের বোঝা ইতোমধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। আমাদের মোট বিদেশী ঋণের পরিমাণ এখন ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি (৭০ বিলিয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২৫ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪/৮৫ টাকা। সে হিসাবে মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের টাকার অঙ্ক ছিল ৮ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংকে ডলারের রেট ১১০ টাকা দরে যদি আমি হিসাব করি তাহলে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ টাকার পতনে এক বছরে আমাদের বিদেশী ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে টাকার মান যে করেই হোক বাড়াতে হবে। তা না হলে সঙ্কট আরও বাড়বে।
গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশী ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশী ঋণসহায়তা এসেছিল। গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে বেশি এসেছিল ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খেয়েছে। এই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছে দাতারা। যা আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরে কম সুদের বিদেশী ঋণ প্রাপ্তিতে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। ওই অর্থবছরে ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিদেশী ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক অর্থবছরে এত বেশি ঋণসহায়তা পায়নি বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৃহস্পতিবার বিদেশী ঋণ ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দাতাদের কাছ থেকে যে ৮৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে, তারমধ্যে প্রকল্প সাহায্য এসেছে ৮৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার। আর অনুদান পাওয়া গেছে ৩ কোটি ১৪ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে প্রকল্প সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ১১০ কোটি ৮৭ লাখ (১.১০ বিলিয়ন) ডলার। অনুদান এসেছিল ৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশে বিদেশী ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের তুলনা নাকচ করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে; আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আর কোভিডের ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণেই বিদেশী ঋণ কমছে। এই কঠিন সময়ে আমাদের দেখেশুনে ঋণ নিতে হবে। কম সুদের ঋণ ছাড়া অন্য ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা, আমাদের বিদেশী ঋণের পরিমাণ এখন ৯৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই ঋণ তো আমরা প্রতি ডলার ৮৪/৮৫ টাকা হিসাবে পেয়েছি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ইআরডি জানায়, এই দুই মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সব থেকে বেশি অর্থছাড় দিয়েছে জাপান ৩২ দশমিক ৯ কোটি ডলার। এর পরেই রয়েছে চীন ১৮ দশমিক ৭ কোটি ডলার। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ভারত ৭ দশমিক ১ শতাংশ, বিশ্বব্যাংক ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, অন্যান্য ৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ ছাড় দিয়েছে। এছাড়া এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ১ দশমিক ৭১ শতাংশ, রাশিয়া ৪ দশমিক ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ছাড় দিয়েছে।
তবে এই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে মোট অনুদান এসেছে ৩০ দশমিক ৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৩০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ৪ দশমিক ৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে। একই সময়ে গত বছর মোট বৈদেশিক অনুদান এসেছিল ৭ দশমিক ৩ কোটি ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক অনুদান ২৩ দশমিক ১ কোটি মার্কিন ডলার বেড়েছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও বেড়েছে। চলতি বছরে সুদ ও মূলধনসহ উন্নয়ন সহযোগীদের ২ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। গত বছর যা ছিল ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), চীন, ভারত, এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), দক্ষিণ কোরিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (কোইকা), পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা (ওপেক), জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন (জিআইজেড), জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (কেএফডব্লিউ), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ৭২ বিলিয়ন আর পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম