প্রকল্পের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর এখন অনেকটা ‘চলো বন্ধু ঘুরে আসি’ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৩০৭ কর্মকর্তার বিদেশ সফর নিয়ে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের দপ্তরের চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করলে এমনটি বলাই যায়।
গত জুনে জাতীয় সংসদে জমা পড়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ প্রকল্পের অধীনে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া এই ৩০৭ কর্মকর্তার প্রায় ২৯ শতাংশই সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। বিদেশে শিক্ষা সফরের শর্তানুযায়ী প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নিয়ম থাকলেও কর্মকর্তারা তা দেননি।
বিজ্ঞাপন
প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর করা হলেও অর্জন করা জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
মাছ চাষ ও কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পগুলোর অধীন কর্মকর্তারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইতালি, জাপান, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলেন। ১৫ দেশে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার এ সফর ঘিরে নানা অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে নিরীক্ষায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশিক্ষণের নামে বয়স্ক কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করানো হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তথা অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিদেশে। নীতিমালা উপেক্ষা করে ভ্যাট, ট্যাক্স না কেটেই প্রশিক্ষণের ফি পরিশোধ করা হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিদেশ সফরে অনিয়ম
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ, ভ্রূণ স্থানান্তর ও প্রযুক্তি বাস্তবায়ন প্রকল্পসহ মোট পাঁচটি প্রকল্পের আওতায় বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৭৯ জন কর্মকর্তা মালয়েশিয়া ও চীন সফর করেছেন। নিরীক্ষায় দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে ২৩ জন বা ২৯ শতাংশ কর্মকর্তাই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার বাইরের কর্মকর্তা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও ব্রুড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্পে ৩২ জন কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ করেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের বয়স ছিল ৫৮ বছরের ওপরে। পাঁচজনের বয়স ছিল ৫৫ বছরের বেশি। সব মিলিয়ে ৫৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মকর্তা ছিলেন মোট সফরকারীর ২১ শতাংশের বেশি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, অবসরে যাওয়ার বয়সের কাছাকাছি থাকা এই কর্মকর্তাদের সরকারি অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণে পাঠানো হলেও তাঁরা অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগ পাবেন না।
শিক্ষা সফরের বিল থেকে নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট ও আয়কর কাটা হয়নি এক প্রকল্পে। এতে সরকারের প্রায় ৯ লাখ ১৯ হাজার টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়।
জানতে চাইলে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর কার্যক্রম দেখভালকারী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. তৌফিকুল আরিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন আমার দপ্তরে আসেনি। মন্ত্রণালয়ের অন্য কোনো দপ্তরে এ প্রতিবেদন এসেছে কি না তা আমার জানা নেই। ’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। পরিচয় দিয়ে মুঠোফোনে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তিনি সাড়া দেননি।
কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তর
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নানা অনিয়ম হয়েছে। প্রকেল্পগুলোর মাধ্যমে ২২৮ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর করেন। এর মধ্যে ৫৫ বছরের বেশি বয়সের কর্মকর্তা ছিলেন ৬৮ জন। এটা মোট সফরকারীর প্রায় ৩০ শতাংশ। তাঁদের মধ্যে ২৩ জন কর্মকর্তার বয়স ছিল ৫৮ বছরের ওপরে। প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটা অন্তরায়। কারণ বিদেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এ বয়সী কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহিত করার কথা।
কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (তৃতীয় পর্যায়), উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তি ও উন্নত পানি ব্যবস্থাপনার কৌশলের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ (ডিএই), সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পসহ সাতটি প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর করেন।
কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পে অস্ট্রেলিয়া, চীন ও ভিয়েতনাম ভ্রমণে যাওয়া ১৭ কর্মকর্তার বয়স ছিল ৫৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া আটজনের মধ্যে ৫৯ বছরের বেশি বয়সী ছিলেন দুজন। চীন ও ভিয়েতনামে যাওয়া ৯ জনের মধ্যে চারজনেরই বয়স ছিল ৫৯ বছরের বেশি।
উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পে ৫৫ বছরের বেশি বয়সের ছয়জন কর্মকর্তা, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পে সাতজন, খামার পর্যায়ে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা কৌশলের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পে চারজন, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ (জিএই) শীর্ষক প্রকল্পে চারজন, সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পে ছয়জন ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন।
নিরীক্ষায় বলা হয়, সরকারি অর্থ ব্যয় করে বিদেশে অর্জন করা জ্ঞানের বাস্তবে প্রয়োগের আগেই অনেক কর্মকর্তা অবসরে চলে গেছেন। বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে বয়সের বিষয়টি বিবেচনা না করায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশে প্রশিক্ষণ আয়োজনের ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন (আরএফকিউ) পদ্ধতিতে তিন কোটি ৩৪ লাখ ৮৬ হাজার ৫৫৯ টাকা খরচ করা হয়েছে। এটি পিপিআর-২০০৮-এর লঙ্ঘন। এর মধ্যে নিয়ম না মেনে কারনাল ইন্টারন্যাশনালকে তিন কোটি ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৯ টাকার কার্যাদেশ ও সেন্টার ফর ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টকে ২৪ লাখ ৪২ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার পর ৭৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা অন্যান্য ব্যয় দেখানো হয়। অথচ এ খাত থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় করার সুযোগ নেই।
চারটি প্রকল্পে সফরের বিল থেকে নির্ধারিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি। এতে সরকারের প্রায় ১৩ লাখ পাঁচ হাজার ৭১৩ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
এ নিয়ে কথা বলার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কেউ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারীও কথা বলতে রাজি হননি। তাঁর দপ্তর থেকেই কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের পরিকল্পনা হয়ে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু জানি না। এসংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন আমি পাইনি। ’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি সংস্থার প্রতিবেদন থেকেই এটা স্পষ্ট, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের নামে কী হয়। এসব বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, উল্লিখিত সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি যাঁরা সফরকারীদের তালিকা করেছেন এবং অনুমোদন দিয়েছেন তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কারণ যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলে বিদেশ ভ্রমণ করা হয়েছিল তা পূরণ হচ্ছে না।