গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে লোভনীয় অফার ঘোষণা করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ই-কমার্স খাতের শতাধিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় কম দামে পণ্য পেতে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিনিয়োগও করেন। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি, গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ আত্মসাৎ আর প্রতারণার দায়ে কোটি কোটি টাকা হারিয়ে পথে বসেন হাজার হাজার গ্রাহক। অনেকেই হন সর্বস্বান্ত। দিশাহারা হয়ে আন্দোলনে নেমেও খুব সুবিধা করতে পারেননি তারা। টাকা ফেরত পাচ্ছেন না বেশির ভাগ গ্রাহক। এ নিয়ে খুব একটা আলাপও নেই। দিন যত গড়াচ্ছে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা তত কমছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলে কখনোই আস্থা ফিরবে না ই-কমার্স খাতে। আর টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে মামলার রায় হওয়া পর্যন্ত।
বিজ্ঞাপন
এদিকে ইভ্যালির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। এখানে আটকে থাকা টাকা কবে, কীভাবে ফেরত হবে, তার কোনো পরিকল্পনা এখনো হয়নি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সূত্র জানায়, আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মাধ্যমে এই খাতে প্রতারণার মুখোশ উন্মোচিত হয়। এর পর একে একে বের হতে থাকে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জ শপ, রিংআইডি, কিউকম, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল প্লাস, বাজাজ কালেকশন, টুয়েন্টিফোর টিকেট ডট কম, গ্রিন বাংলা, এসপিসি ওয়ার্ল্ডসহ বিভিন্ন প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠানের থলের বেড়াল। একইসঙ্গে প্রতারণার শিকার হওয়া গ্রাহকরাও মুখ খুলতে থাকেন। মামলাও করেন অনেকে।
এরপর গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালক ও কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া পলাতক আছেন একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সিইও। আর এতেই মামলা হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আটকে যায় গ্রাহকের টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্তেও অগ্রগতি নেই। এই টাকা তারা কবে ফেরত পাবেন তারও কোনো সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগাম অর্থ পরিশোধ করে এখন টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় তারা। নিজের টাকা বিনিয়োগ করে আহাজারি করছেন গ্রাহকরা। দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এখন যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে গ্রাহকদের পাওনা মেটানো সম্ভব নয়। ফলে গভীর হতাশা নেমে এসেছে গ্রাহকদের মাঝে। তবে ৫১৪ কোটির কিছু বেশি টাকা গেটওয়েতে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক তা আটকে দিতে পেরেছে বলে জানা গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০শে জুনের পরে লেনদেন পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানে (পেমেন্ট গেটওয়ে) ২৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের মোট অর্থ আটকে ছিল ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১৮২ কোটি ৪১ লাখ টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছে।
নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়া গ্রাহকের সংখ্যা ২০ হাজার ২৯৯। বাকি ৩৪৩ কোটি টাকা গ্রাহকেরা কবে ফেরত পাবেন তা বলতে পারছে না কেউ। তবে পুরো বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বলে গ্রাহকেরা আস্তে আস্তে টাকা ফেরত পাবেন বলে আশাবাদী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ই-কমার্স খাতের রমরমা বাণ্যিজ্যের সময় ৩৫ ভাগ ছাড়ের সুযোগ নিতে ধার করে আলেশা মার্টে ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকায় দু’টি মোটরসাইকেলের অর্ডার দিয়েছিলেন অনার্স ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী আমির মোহাম্মদ। এক বছর আগে টাকা দেন তিনি। ৪৫ দিনের মধ্যে মোটরসাইকেল বুঝে দেয়ার কথা থাকলেও এক বছর পরেও লগ্নিকৃত টাকাও ফেরত পাননি তিনি। আমির জানায়, মোটরসাইকেল না দিয়ে তিন মাস পর আলেশা মার্ট আমাকে ব্যাংকের চেক দিয়েছিল। কিন্তু সেই চেক দিয়ে এখনো টাকা তুলতে পারিনি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে টাকা না থাকায় টাকা তুলতে পারিনি। শুধু আমির মোহাম্মদ নয়, এভাবে বিভিন্ন ছাড়ে মোটরসাইকেল, গাড়িসহ নানা পণ্য অর্ডার করে সেই পণ্য বা টাকা ফেরত পাননি হাজার হাজার গ্রাহক। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আলমগীর হোসেন।
তিনি জানান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই কিনতে দেখে আমিও আগ্রহী হই। এক বছর আগে ধামাকার ঝড় অফারে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় একটি পালসার মোটরসাইকেল অর্ডার দিয়েছিলাম। ১৫ মাস হলো এখন পর্যন্ত টাকাও পাইনি, মোটরসাইকেলও পাইনি। কেউ কোনো দিন ফোনও দেয়নি। জানা গেছে, কয়েক মাস আগে ই-কমার্সের ওপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়। এতে ৬টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া মোট ২৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান কিছু গ্রাহকের টাকা ফেরত দিলেও বাকি ১৪টি ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেনি। ওই সময় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছিলেন, টাকা ফেরতের বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অনলাইন কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে করোনার সময় এর প্রসার আরও বাড়ে। কিন্তু হঠাৎ করে এই খাতে গজিয়ে উঠা ব্যবসায়ী, প্রতারণার মানসিকতায় সম্পৃক্ত হওয়া, গ্রাহকদের অতিলোভের কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সম্ভাবনাময় এই খাত। জানা যায়, দেশে বর্তমানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। আর এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) আছে আরও ৫০ হাজারের বেশি। আজকের ডিল ও বিডিজবস-এর সিইও ফাহিম মাশরুর বলেন, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের জন্য সকলের বদনাম হতে পারে না। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ভালো সেবা দিচ্ছে এবং এই কারণে এটি বিকশিত হচ্ছে। সেবা না পেলে ভোক্তারা এখানে আসতো না। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, যেসব ই-কমার্স কোম্পানির নামে মামলা রয়েছে, প্রয়োজনে সেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে গ্রাহকদের পাওনা অর্থ ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
এদিকে বাংলাদেশের আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির কার্যক্রম আবার শুরু হচ্ছে। যদিও এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেলের সময়ে পরিচালিত কর্মকাণ্ড অডিট করে ৪৭ হাজার কোটি টাকার হদিস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বিদায়ী বোর্ড প্রধান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। গ্রাহক ঠকানোর মামলায় মোহাম্মদ রাসেল এখনো জেলে। তবে তার স্ত্রী, শাশুড়ি এবং আরেকজন নিকটাত্মীয়কে নিয়ে নতুন বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। রাসেলের স্ত্রী শামীমা নাসরিন জামিনে মুক্ত আছেন। এখন শামীমা নাসরিনকে নিয়ে করা বোর্ড গ্রাহকদের স্বার্থ কতোটা রক্ষা করতে পারবে- সেটাও একটি বড় প্রশ্ন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সোর্স : মানব জমিন