ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিলো যে, এ সংকটকালে সরকার ডলার ব্যয়ে সাশ্রয়ী হবে। প্রথম প্রথম কিছু কিছু সাশ্রয়ী পদক্ষেপও সরকার নিয়েছিলো। এই যেমন- অকারণে সরকারি কর্মকর্তাদের দলে দলে বিদেশ ভ্রমণ। কেনাকাটায় বারগেইনিং প্রভৃতি বিষয়ের উপর রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেছিলো। এদিকে প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স পাঠানো কমে আসছে। সরকারই বলছে, এই রেমিট্যান্স আরো বাড়তে পারতো, যদি না হুন্ডিবাজরা তৎপর না থাকতো। কিন্তু হন্ডি চলছে হরদম। কিছুদিন স্থগিত থাকার পর ফের তৎপর হয়েছে আমলারা। হবেই বা না কেন? আমলারা বহু ক্ষেত্রে এমপি মন্ত্রীদের চেয়ে অধিকতর চতুর ও বুদ্ধিমান। ফলে তারা ফের শুরু করেছে দলে দলে বিদেশ ভ্রমণ। আমরা দেখেছি পুকুর কাটা শিখতে, খিঁচুড়ি রান্না শিখতে, শিশুদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ শিখতে ঝাঁক ঝাঁক সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী বিদেশ সফরে গেছেন। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে লাখ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। সরকারি কৃচ্ছ্রতার কারণে সেই ভ্রমণে কিছুটা ভাটা পড়েছিলো। কিন্তু আমলাদের কৌশলের কাছে হেরে গেছে সরকার। ফলে তারা সরকারের উপর এমন কৌশলী চাপ প্রয়োগ করেছে যে, সরকার আমলাদের বিদেশ ভ্রমণের নীতিমালা শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে। আবার শুরু হয়েছে মূল্যবান ডলার ব্যয় করে আমলাদের দলে দলে বিদেশ সফর। সরকারের তরফ থেকে মুখে বড় বড় কথা বলা হলেও কাজে তার কোন প্রতিফলন নেই।
আমলারা এবং সরকারও বিশ্বাস করে যে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাদের তথাকথিত বিজয়ে আমলারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। শুধু আমলা নয়, এক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। ফলে তারাও নানাভাবে ক্ষমতার ভাগ চায় কিংবা আর্থিকভাবে লাভবান হতে চায়। আর যেহেতু তারা মনে করে যে, সরকারকে তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছে অতএব তাদের ইচ্ছেও অনেককিছু চলতে হবে। একারণেই অতিরিক্ত ডলার ব্যয় হচ্ছে।
আর বাজার মূল্যের বেশি দামে জিনিসপত্র কেনায় সরকারের বড় বেশি ঝোঁক। এগুলো আমরা সচরাচর খুব বেশি টের পাই নাই। কিন্তু ভারত থেকে যখন করোনার টিকা কেনার চুক্তি হলো তখন আমরা বুঝতে পারলাম সরকার ও তার এজেন্টরা কীভাবে লক্ষ লক্ষ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। তখন চীন ও রাশিয়া কম দামে করোনার টিকা বিক্রির প্রস্তাব করলেও সরকার প্রায় দেড়গুণ দামে ভারত থেকে টিকা আমদানির চুক্তি করে। এই চুক্তি সরকার টু সরকার থাকলেও সরকার মাঝ পথে প্রধানমন্ত্রীর শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মাধ্যমে টিকা কেনার চুক্তি করে এবং চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে টিকার সবটা অর্থই ডলারে পরিশোধ করে। একদিকে বেশিদামে টিকা কেনার চুক্তি অপরদিকে মাঝখানে এজেন্ট ফলে টিকা কেনা হলো প্রায় ডাবল দামে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভারতীয় কোম্পানি সামান্য কিছু টিকা দিয়ে নিজ দেশের চাহিদার অজুহাতে বাংলাদেশে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সরকারকে বাড়তি টাকা ফেরত দিয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি। এই টাকা কী ভারতীয় কোম্পানি খেয়েছে নাকি মধ্যস্বত্বকারী প্রতিষ্ঠান খেয়েছে তা নিয়ে কোন তদন্ত হয়নি। লক্ষ লক্ষ ডলার লোপাট হয়ে গেছে।
একই ঘটনা ঘটেছে রাশিয়া থেকে গম আমদানি ও বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি নিয়ে। উৎপাদন কম হওয়ায় এই আমদানির সিদ্ধান্ত। কম বৃষ্টির কারণে এবছর বোর, আউস ও আমন ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদন হচ্ছে না। সরকার ধারণা করছে এ পরিস্থিতিতে নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। তারই প্রতিকার ব্যবস্থা হিসেবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বিশ্ববাজার থেকে দশ লাখ টন চাল ও নয় লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এই সিদ্ধান্তকে যথাযথই বলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এর মূল্য নিয়ে। খাদ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ববাজার থেকে গম আমদানির অংশ হিসেবে রাশিয়া থেকে আমদানি করছে ছয় লাখ টন গম। এই গম নিম্নমানের বলে পরিচিত। আগস্ট মাসের শেষদিকে যখন রাশিয়া থেকে গম আমদানির চুক্তি করা হয় তখন আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য ছিলো টন প্রতি তিনশ ডলারের কাছাকাছি। জাহাজের পরিবহন ব্যয় এখন কিছুটা বাড়তি সে কথা সবাই মানবেন। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় রাশিয়া থেকে প্রতি টন গম কিনছে চারশ তিরিশ ডলারে। এটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে সবকিছু বিবেচনায় সবচেয়ে কমদামে রাশিয়ান গম কেনা হচ্ছে। বিদেশ থেকে সরকারি পর্যায়ে চাল ও গম কেনার ক্ষেত্রে বিশ্ববাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া ও দরদাম করার জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৭ই আগস্ট খাদ্য অধিদফতর টেন্ডার আহ্বান করলেও কোন এক রহস্যজনক কারণে সে দরপত্র বাতিল করে দেয়া হয় ১৯শে আগস্ট।
অপর দিকে রাশিয়া থেকে সরকারি পর্যায়ে পাঁচ লাখ টন গম কেনায় তৃতীয় একটি পক্ষকে সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে যুক্ত করা হয়েছে। গণখাতে ক্রয় আইন অনুযায়ী এরকম কোন সুযোগ নেই। অথচ রাশিয়া থেকে গম কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি মধ্যস্থতা করছে ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক নামের একটি কোম্পানি। আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ান গমের শীর্ষ স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ইউনাইটেড গ্রেন কোম্পানি। অথচ বাংলাদেশ চুক্তি করেছে দেশটির প্রোডিনিট্রন নামের ছোট একটি কোম্পানির সঙ্গে। এ থেকেই বোঝা যায় সরকারের ভেতরকার ‘মিডলম্যানরা কী পরিমাণ সক্রিয়।’ এতসব জালিয়াতি করা যদি সম্ভব না হতো তাহলে ন্যূনতম পঞ্চাশ ডলার করে অর্থ সাশ্রয় হতো।
একই ঘটনা ঘটেছে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল ক্রয় নিয়ে। মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং সেটাও বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের। যদিও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী গুদামে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। তাহলে বেশি দামে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির হেতু কী? সরকার আশা করেছিলো চাল আমদানি করবে ভারত থেকে। কিন্তু বাংলাদেশ যেই বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে অমনিই ভারত চালের উপর রপ্তানি শুল্ক ২০% বাড়িয়ে দিয়েছে। উপরন্তু সরকার চালে আমদানি শুল্ক ২৫% থেকে ৫% করেছে। দেশের শীর্ষ তিন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে তারা মূলত তিনশ’ আশি থেকে চারশ’ ডলারে চাল আমদানি করছে। চলতি মাসের যেসব প্রতিষ্ঠান চাল আমদানির ঋণপত্র খুলেছে তারাও চারশ’ ডলারে কিনছে। অথচ সরকার জিটুজি পর্যায়ে ভারত থেকে চারশ’ পঁয়ষট্টি ডলারে চাল কিনছে। এতে বেসরকারি খাতের ভারতীয় ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যবসায়ীরা। চাল ব্যবসায়ী চিত্ত মজুমদার পত্রিকায় বলেছেন, সরকার ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাছ থেকে আমাদের চেয়ে বেশি দামে কেন চাল কিনছে? তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এ সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বলেন, খাদ্য কেনায় এ ধরনের অভিযোগ আগেও উঠেছিলো। তবে দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে সবচেয়ে কম দামে খাদ্য কেনা উচিত। ব্যবসায়ীরা কম দামে চাল, গম আনতে পারলে সরকার কেন বেশি দামে কিনছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
তবে বেশি দামে না কিনলে আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বাঁচবে কী খেয়ে? সরকার যদি তাদের না দেখেন তাহলে কে “দেখিবে”।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম