দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের সাত নয়, দশ বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা রয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এর দু-তিন দিন আগে উপজেলার ট্রেজারিতে প্রশ্নপত্র সর্টিং (বাছাই) হয়েছে।
এ সময় উপজেলা পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে এ সময়ই কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান প্যাকেটসহ এসব প্রশ্ন বের করে নেন, যা পরে প্রশাসন তার কক্ষ থেকে এসব উদ্ধার করে।
সব সদস্যের যোগসাজশ ছাড়া একা কেন্দ্রসচিবের পক্ষে এই দুঃসাহসিক কাজ করা সম্ভব নয়। এমনটিই মনে করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি।
যেসব বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের শঙ্কা করা হচ্ছে সেগুলো হলো : গণিত, কৃষিশিক্ষা, রসায়ন, পদার্থ, উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞান। এছাড়া সন্দেহের তালিকায় আছে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জেলা পুলিশের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। এদিকে প্রথম ছটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে নতুন প্রশ্নে। আর বাকি চারটির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত চারটি পরীক্ষা বাতিল করেছে। বৃহস্পতিবারই বাতিল পরীক্ষার নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। নতুন রুটিন অনুযায়ী ১০ অক্টোবর গণিত, ১১ অক্টোবর কৃষিশিক্ষা, ১৩ অক্টোবর রসায়ন এবং ১৫ অক্টোবর পদার্থ বিজ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হবে।
এছাড়া উচ্চতর গণিত এবং জীববিজ্ঞানের প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু এ দুটি পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কারণ আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর পরীক্ষা দুটি নির্ধারিত আছে। এর আগেই এ পরীক্ষা দুটির প্রশ্ন ছাপানো সম্ভব।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক ফারাজ উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় সরেজমিন কাজ শুরু করেছে। এছাড়া মাউশির নির্দেশে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমানের দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হয়েছে।
এজন্য তাকে বৃহস্পতিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া এ ঘটনায় পুলিশ নতুন করে আরও ৩ জনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। তারা বুধবার থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। তিনজনের মধ্যে আছেন নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন ও পদার্থবিজ্ঞানের হামিদুল ইসলাম। এছাড়া অফিস সহায়ক সুজন মিয়াও গ্রেফতার হয়েছেন। এ নিয়ে ৬ জন গ্রেফতার হলেন। তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করছেন পরীক্ষা বিশেষজ্ঞরা। কেননা প্রশ্নপত্র উপজেলায় পৌঁছানোর পর পরীক্ষা শুরুর ২-৩ দিন আগে ‘উপজেলা পাবলিক পরীক্ষা কমিটি’র সদস্যদের সামনেই বাছাই করা হয়েছে। ওইদিন ছাড়া অন্য তারিখে প্রশ্ন ট্রেজারি থেকে সরানো সম্ভব নয়। কেননা, যেদিন যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকে, সেদিন কেবল সেই প্রশ্ন নেওয়া হয়। যদি তাই হয়, তাহলে এত সদস্যের সামনে কেন্দ্রসচিব প্রশ্ন কীভাবে সরালেন-এটি এখন বড় প্রশ্ন।
তাই ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘটনায় অন্যরাও জড়িত থাকতে পারেন। তাই মামলার বাদী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের আসামি হবেন কি না, সেটাও তদন্তেই বেরিয়ে আসবে বলে মাউশি সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পরীক্ষার দু-একদিন আগে প্রশ্নপত্র সর্টিং করা হয়। মূল প্রশ্ন থাকে ফয়েল পেপারে, যার উভয় মুখ মেশিন দিয়ে লাগানো থাকে। এর ওপরে প্রশ্নসংখ্যা ও বিষয়ের নাম থাকে।
আবার ফয়েল পেপারের খাম কাগজের আলাদা খামে থাকে। সেটি পরীক্ষা কমিটির সবার সামনে খুলে সর্টিং করা হয়। তাই ঘটনা যা ঘটার, তা পরীক্ষার আগেই ঘটে থাকতে পারে। কেননা অন্যদিন অন্য কোনো বিষয়ের প্রশ্নের খাম সরানো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তার দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হয়েছে। এখন তদন্তে যদি তার জড়িত থাকার বিষয় প্রমাণিত হয়, তখন প্রশাসনিক এবং প্রচলিত আইনে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, ‘অন্য কর্মকর্তারা আমাদের অধীনে নন। তাই চাইলেই আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।’
যুগান্তরের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পরীক্ষা গ্রহণের বিদ্যমান ব্যবস্থা অনুযায়ী দশ বিষয়ের প্রশ্নই ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের দিন থেকে বিষয়টি শহরে চাউর হতে শুরু করে। আর ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষার আগে মুখে মুখে ছড়াতে থাকে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার আগে তা ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এটি বের হয়।
এরপরই বিষয়টি সাংবাদিকদের নজরে এলে তারা উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে স্থানীয় প্রশাসন পুলিশের সহায়তায় কেন্দ্রসচিবের কক্ষে অভিযান চালিয়ে বুকসেলফের ভেতরে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় বাতিল ৪ বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে। প্রতিটি প্যাকেটই খোলা ছিল। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নফাঁসের কারণে কেন্দ্রসচিব প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার যুগান্তরকে বলেন, বাংলা ও ইংরেজির চার বিষয়ের প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি আমরা এখনো নিশ্চিত নই। এখন তদন্তে প্রমাণিত হলে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। তিনি আরও বলেন, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে যেসব প্রশ্ন উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে জীববিজ্ঞান আর উচ্চতর গণিতের পরীক্ষা যথাক্রমে ২৮ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর নেওয়া হবে। আমরা এর আগেই প্রশ্ন ছাপাতে পারব। তাই ওই পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কিন্তু বাকি চারটির মধ্যে গণিতের পরীক্ষা ছিল বৃহস্পতিবার। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞান ২৪ সেপ্টেম্বর, কৃষিশিক্ষা ২৫ সেপ্টেম্বর ও রসায়ন ২৬ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত ছিল।
কিন্তু এগুলো ছাপানো শেষ হবে না বিধায় বাতিল করা হয়েছে। এ ছয়টি পরীক্ষাই নতুন প্রশ্নে নেওয়া হবে। ইতঃপূর্বে আমরা ৩৬ সেট প্রশ্ন তৈরি করেছি। যার মধ্যে ১৮ সেট ছাপানো হয়েছিল। এখন প্রতিটি পরীক্ষার জন্যই একাধিক সেট প্রশ্ন ছাপানো হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক তপন বলেন, প্রশ্ন সর্টিং করা হয় গোটা পরীক্ষা কমিটির সামনে। আর ট্রেজারি থেকে দৈনিক প্রশ্ন আনার সময়ে কমপক্ষে তিনজন থাকেন। তারা হলেন-ট্যাগ অফিসার, পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং কেন্দ্রসচিব। যদি সর্টিং করার সময়ে প্রশ্ন সরানো না হয়, তাহলে পরীক্ষার যে কোনোদিন সরানো হয়। এ অবস্থায় কমপক্ষে তিনজনের যোগসাজশ ছাড়া অপকর্ম হওয়া কঠিন।
এখন যদি শুধু প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন এনে থাকেন, তাহলে বাকি দুজনের দায়িত্বে অবহেলা আছে। আর যদি তাদের উপস্থিতিতে ঘটে থাকে, তাহলে যোগসাজশ থাকাই স্বাভাবিক। এখন আসলে কী ঘটেছে, সেটি জানতে তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এ ঘটনার কারণে এসএসসির ফল প্রকাশের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানান আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের এই আহ্বায়ক। তিনি বলেন, ১ অক্টোবর পরীক্ষা শেষ হয়েছে-এমনটি ধরেই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফল প্রকাশ করা হবে। এ লক্ষ্যে দিনাজপুর বোর্ডকে কারিগরি সহায়তা প্রদানসহ অন্যান্য কাজ সমন্বয় করা হবে। সমন্বয়ক হিসাবে আমি এই কাজটি করব।
দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও ভুরুঙ্গামারী প্রতিনিধি জানান, মাউশির পক্ষে বৃহস্পতিবার নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয় পরীক্ষাকেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শন করেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামছুল ইসলাম।
তিনি প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমানসহ অন্য শিক্ষকদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। তিনি মূলত শিক্ষা বিভাগের কারও কোনো দায়িত্বে অবহেলা কিংবা প্রশ্নফাঁসে সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে আদিষ্ট হয়েছেন।
অন্যদিকে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটি। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখাকালে কমিটি ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিল। কমিটির আহ্বায়ক ও বোর্ডের পরিদর্শক অধ্যাপক মো. ফারাজ উদ্দিন তালুকদার, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. হারুন অর রশিদ মন্ডল এবং মাউশির রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. আকতারুজ্জামান তদন্ত কাজ করেছন। এ ব্যাপারে অধ্যাপক হারুন অর রশিদ মণ্ডল সন্ধ্যা ৬টার দিকে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা ৩০ মিনিট আগে কাজ শুরু করেছি। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’
আসামিরা কারাগারে : কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার ৬ জনকেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে এক নম্বর আসামি লুৎফর রহমানকে বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়।
ভুরুঙ্গামারী কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও) সিরাজুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আজাহার আলী এই শিক্ষকের ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন। কিন্তু আসামিপক্ষে জামিনের আবেদন করা হয় আদালতে। তবে বিজ্ঞ বিচারক মো. সুমন আলী রিমান্ড ও জামিন শুনানির জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে আদেশ দেন। এ ঘটনায় ৪ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসহ ১০/১৫ জন আসামি। তাদের বিরুদ্ধে বুধবারই পাবলিক এক্সজামিনেশন অফেন্স অ্যাক্ট ১৯৮০-এর ৪/১৩ ধারায় মামলা করা হয়।
আরও মামলা হবে : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকেও মামলা হবে। বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, তদন্ত কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যেই রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে বোর্ডের পক্ষ থেকেও একটি মামলা করা হবে। তিনি জানান, তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম আসবে, তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হবে।
সোর্স : যুগান্তর