সামাজিক অবক্ষয়, ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের আগ্রাসন, পর্নোগ্রাফি, অবাধ মেলামেশা মূলত এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী করছেন অপরাধ গবেষকরা
ভ্রুণ হত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে কবিরা গোনাহ বা মহাপাপ। একটি মানব হত্যা আর ভ্রুণ হত্যার মধ্যে অপরাধের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য নেই। যারা একাজটি করছেন বা এতে সায় ও সহায়তা করছেন প্রত্যেকেই শরীয়তের দৃষ্টিতে মানুষ খুনের দায় মাথায় নিচ্ছেন : মুফতি মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
গুম, খুন ও অপহরণের মিছিলের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে নবজাতক হত্যার সংখ্যা। এ ঘটনা এখন আর কাউকে আলোড়িত করে না। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অধঃপতন কতটা হলে নবজাতককে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আরবের অন্ধকার যুগে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত যেভাবে পুতে ফেলা হতো এ যুগেও কিছু ডাস্টবিন কিংবা ময়লার ভাগাড়ে নবজাতককে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের আল্লাহতায়ালার বাগানের পাখির সাথে তুলনা করেছেন। যারা নবজাদত হত্যা করছেন বা এতে সায় ও সহায়তা করছেন প্রত্যেকেই শরীয়তের দৃষ্টিতে মানুষ খুনের দায় মাথায় নিচ্ছেন।
গত এক বছরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ সময়ে শুধু রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় থেকে পাঁচটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধারকৃত নবজাতকদের পরিচয় না পাওয়ায় তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার ২০ সেপ্টেম্বর রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় থেকে এক ছেলে নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে শাহবাগ থানার পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
অপরাধ গবেষকরা বলছেন, যে কোনো জায়গায় এসব শিশুদের ফেলে দেয়া হচ্ছে। ব্যাগে, বস্তায়, কাপড়ে মুড়িয়ে। কোনও শিশুর কান্না মানুষের কাছে পৌঁছালে ভাগ্যচক্রে বেঁচে যাচ্ছে। আর এসব ঘটনায় মামলা হলেও আসামি খুঁজে পাওয়া যায় না। সামাজিক অবক্ষয়, ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের আগ্রাসন, পর্নোগ্রাফি, অবাধ মেলামেশা মূলত এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী।
নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছেÑ নারী-পুরুষ। ফলে এ নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জীবন্ত শিশুকে ফেলে দিয়ে যাওয়ার ঘটনাও।
গত বুধবার শাহবাগ থানার এসআই মো. আরাফাত হোসেন বলেন, গত এক বছরে শহীদ মিনার এলাকা থেকে ৫টি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পরে ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়। তাদের পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে থাকে। গত মঙ্গলবারে উদ্ধার হওয়ার নবজাতকের বিষয়ে জানান, খবর পেয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকার ফুটপাত থেকে নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ ঢামেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়।
তিনি আরও জানান, কে বা কারা ওই নবজাতককে ফুটপাতে ফেলে রেখে যায়। কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, গত এক বছরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ নবজাতককে ডাস্টবিন, জঙ্গল ও রাস্তা থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ মামলা করায় অধিকাংশ নবজাতকের ময়নাতদন্তও হয়েছে। সেই ময়নাতদন্তের ওপর ভিত্তি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ডিএনএ প্রোফাইলও তৈরি করেছে। কিন্তু উন্নত দেশের মতো ডিএনএ ব্যাংক না থাকায় ডিএনএ ম্যাচ করানো সম্ভব হয়নি। আর তাই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া মৃত নবজাতকদের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী অদৃশ্যই থেকে গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা করে। মামলা চলতে থাকে। কিন্তু নাবজাতকের মা-বাবার পরিচয় পাওয়া যায় না। ফলে নবজাতক হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা থেকে যায় অধরা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, যত নবজাতক উদ্ধার হয়, সবগুলোর ময়নাতদন্ত হয় না। এ বাচ্চাগুলো সাধারণত প্রিম্যাচিউর হয়। বলতে গেলে সবগুলোই অ্যাবরশন করা। পুলিশ চাইলে আমরা ময়নাতদন্ত করি। শরীরের টিস্যু বা হাড় সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইল করে সিআইডিতে পাঠাই।
তিনি আরো বলেন, নবজাতকদের সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচ করা আমাদের দেশে অসম্ভব। কেননা, আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। এটি থাকলে অনেক অপরাধই কমে যেত। উন্নত দেশে প্রত্যেক নাগরিকের ডিএনএ প্রোফাইল রয়েছে। ডিএনএ ব্যাংকে সেগুলো সংরক্ষণ করা থাকে। যেকোনও ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে তারা ডিএনএ ব্যাংক থেকে চটজলদি ম্যাচ করে ফেলে।
মুফতি মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী বলেন, ভ্রুণ হত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে কবিরা গোনাহ বা মহাপাপ। একটি মানব হত্যা আর ভ্রুণ হত্যার মধ্যে অপরাধের দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য নেই। কেবল ধার্মিক নীতিবান চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে গর্ভনিরোধ বা গর্ভপাত শরীয়তে বৈধ রয়েছে যতক্ষণ গর্ভের বস্তুটিতে প্রাণের সঞ্চার না ঘটে। এটিও কেবল মা ও শিশুর প্রাণের ঝুঁকি তৈরির বেলায় কোনোরকম জায়েয। কিন্তু ভ্রূণের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার এমনকি পূর্ণ মানবশিশু গঠিত হয়ে প্রসবের কাছাকাছি সময়ে যে কোনো প্রকাশ্য কিংবা গোপন অজুহাতে তাতে হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম ও কবিরা গোনাহ। যারা একাজটি করছেন বা এতে সায় ও সহায়তা করছেন প্রত্যেকেই শরীয়তের দৃষ্টিতে মানুষ খুনের দায় মাথায় নিচ্ছেন।
মুফতি মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ যৌনমিলন থেকে জন্ম নেয়া শিশুকে, পিতামাতার অনভিপ্রেত সন্তান কিংবা কেবল কন্যাশিশুকে এমন প্রাণবিশিষ্ট ভ্রুণ অথবা পূর্ণ মানব শিশু অবস্থায় খুন হতে হয়। এতে ব্যভিচারের গোনাহ, শিশু হত্যার গোনাহএবং কন্যাশিশুকে হেয় মনে করে হত্যার গোনাহহয়ে থাকে। তিনগুণ ভয়াবহ গোনাহএখানে একসাথে জমা হচ্ছে। অপরদিকে বৈধ বা অবৈধ নির্বিশেষে যেকোনো সন্তানকে হত্যা ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে শিশুজন্ম, গর্ভ, ভ্রুণ, কন্যাশিশু হত্যাসহ সব ধরনের অপরাধের বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এবিষয়ে ইসলামী আইনশাস্ত্রে বিশদ বিধিমালা বর্ণিত আছে। অবাধ গর্ভপাত, ভ্রুণ ও নবজাতক হত্যা এবং নবজাতককে পরিত্যক্ত করার মতো গোনাহের কাজ বন্ধে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত রাখার বিকল্প নেই।
ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) ফারুক হোসেন বলেন, পরিত্যক্ত শিশুকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলে প্রথমেই পুলিশে জানানো হয়। মৃত হলে নবজাতকের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। তাদের ডিএনএ টেস্ট করা হয় না। কারণ এ ক্ষেত্রে কখনোই নবজাতকের প্রকৃত বাবা-মাকে পাওয়া যায় না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সনদ দেয়া হলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে পাঠানো হয় দাফনের জন্য। আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলে আমরা নবজাতকের পাওয়ার খবর টিভি চ্যানেলে স্ক্রলে দিয়ে দেই। কোনো অভিভাবক না পাওয়া গেলে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে দেয়া হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পরিত্যক্ত নবজাতকের বয়স এক বা দুই দিন হয়ে থাকে। তবে নবজাতক থেকে শুরু করে এক বছরের মধ্যেও অনেক শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। অনৈতিক সম্পর্ক এবং কিশোর-কিশোরীদের আবেগের ফলে জন্মানো এসব শিশুকে হাসপাতালে, ডাস্টবিনে, রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড এবং গণশৌচাগার থেকে পাওয়া যায়। সচেতনতা না বাড়ালে পরিত্যক্ত নবজাতকের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়বে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
সোর্স : ইনকিলাব