দেশে কয়েকদিন ধরেই করোনা সংক্রমণ বেশ ঊর্ধ্বমুখী। শনাক্তের হার ফের প্রায় ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শনাক্তও ৬শ’র উপরে। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, অবহেলার কারণে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। তারা জাতীয় কারিগরি কমিটির পরামর্শ মানার তাগিদ দিয়েছেন। একইসঙ্গে এখন সীমিত যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরকে কন্টাক্ট ট্রেসিং করার পরামর্শ দিয়েছেন। যারা শনাক্ত হবেন তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আইসোলেশনে চিকিৎসা দিতে হবে বলেও তারা মত দেন। যারা টিকা গ্রহণ করেননি তাদেরকে দ্রুত টিকা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২১শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১৩ কোটি ২২ লাখ ৮ হাজার ৫৬ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬ জন।
অন্যদিকে বুস্টার ডোজ নিয়েছেন মাত্র ৪ কোটি ৫২ লাখ ২৮ হাজার ৩৪৬ জন। ফের করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মানবজমিনকে বলেন, যেভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে তাতে একে নতুন আরেকটি ঢেউ বলা যায়।
করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী আচরণকে দমনে সরকারের কৌশল নিতে হবে। এখন এই সীমিত যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদেরকে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা দরকার। তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে এন্টিজেন্ট ও পিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে। যারা শনাক্ত হবেন তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আইসোলেশনে চিকিৎসা দিতে হবে। এই জনস্বাস্থ্যবিদ আরও বলেন, জনগণকে সঠিকভাবে সঠিক মাস্ক পরতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে উদ্বুদ্ধ এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। যারা টিকা নেননি তাদেরকে দ্রুত টিকা নিতে হবে। যারা এখনো বুস্টার ডোজ নেননি তাদেরকে এই ডোজ দ্রুত নিতে হবে। আর যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন তাদেরকে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উপজেলা হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। এখানে জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি উপজেলায় হাসপাতাল শক্তিশালী করতে পারলে মহামারি এবং অতিমহামারি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, করোনা নিয়ে অবহেলা হচ্ছে। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সুপারিশ দিচ্ছেন, তা বাস্তবায়নে ঢিলাঢালাভাব দেখা যাচ্ছে। এই জনস্বাস্থ্যবিদ বর্তমান করোনার ঊর্ধ্বমুখী আচরণকে করোনার ষষ্ঠ ঢেউ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে বলেন, হাসপাতাল থেকে করোনা বেশি ছড়াচ্ছে।
আমাদেরকে দূরত্ব মানাতে কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, আমরা মাস্ক পরা ভুলে গেছি। বাজারে বিপণিবিতানে, গণপরিবহনে কোথায় মাস্ক পরছে না। রাজনৈতিক সমাগম হচ্ছে। মসজিদে মাস্ক পরার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। ডা. মুস্তাক হোসেন আরও বলেন, করোনার টেস্টও কম হচ্ছে। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে টেস্ট করানো প্রয়োজন বলে তিনি পরামর্শ দেন। পাশাপাশি যারা এখনো ভ্যাকসিন নেননি তাদেরকে দ্রুত ভ্যাকসিন নেয়ার পরামর্শ দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি কয়েকদিন ধরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ায় পাঁচ দফা সুপারিশ দিয়েছে। এরমধ্যে আছে সব ক্ষেত্রে শতভাগ সঠিকভাবে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের জন্য জনসাধারণকে উৎসাহিত করা। এর পাশাপাশি প্রথম, দ্বিতীয় এবং বুস্টার ডোজের করোনার টিকা যারা গ্রহণ করেননি, তাদের টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করারও সুপারিশ করা হয়। বদ্ধস্থানে সভা করা থেকে বিরত থাকা ও দাপ্তরিক সভাগুলো যথাসম্ভব ভার্চ্যুয়ালি করার সুপারিশ করে কমিটি। অপরিহার্য সামাজিক অনুষ্ঠান বা সভাগুলোতে মাস্ক পরার সুপারিশও করা হয়।
আর বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড-১৯ পরীক্ষার ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় কমিটি। করোনা শনাক্ত ৬৭৮ জন: হঠাৎ লাফিয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন ৬৭৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৬৪১ জন। ৬৭৮ জনের মধ্যে রাজধানীতেই ৫২৬ জন শনাক্ত হয়েছেন। নতুন শনাক্ত নিয়ে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ২০ লাখ ২০ হাজার ১৪৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ পৌঁছেছে। আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ১৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯ হাজার ৩৪৬ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩৯ জন এবং এখন পর্যন্ত ১৯ লাখ ৬১ হাজার ৮১৯ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে ৮৮১টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ৮১২টি নমুনা সংগ্রহ এবং ৪ হাজার ৭৯৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৪৮ লাখ ৪১ হাজার ৩৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক ১১ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। দেশে মোট পুরুষ মারা গেছেন ১৮ হাজার ৭৩২ জন এবং নারী ১০ হাজার ৬১৪ জন। নতুন শনাক্তের মধ্যে ঢাকা মহানগরের রয়েছেন ৫২৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে রয়েছেন ৫৬৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৫ জন, রংপুর বিভাগে ৭ জন, খুলনা বিভাগে ৭ জন, বরিশাল বিভাগে ১১ জন এবং সিলেট বিভাগে ১০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
সোর্স : মানব জমিন