স্টাফ রিপোর্টার: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকার মানুষের আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। এখনো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থেমে থেমে চলছে গুলী। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে পর পর বেশ কয়েকটি ভারী গোলার শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা। এদিকে রোহিঙ্গা প্রবেশ ঠেকাতে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে কঠোর নজরদারি করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি)।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. হাবিব উল্লাহ জানান, রাতের আঁধার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়তে থাকে। ফলে সন্ধ্যা নামার আগেই অনেকে এলাকা ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে যান। দিল মোহাম্মদ নামের এক রোহিঙ্গা জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মিদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে গোলা নিক্ষেপের ঘটনায় সীমান্ত এলাকা কেঁপে উঠছে। সকালেও মিয়ানমারের ভেতরে তমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে পূর্বদিকে ভারী গোলা নিক্ষেপের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। এর আগে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম কোনারপাড়া এলাকা রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় পড়ে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হন। ঘুমধুম ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন জানান, সকালে কয়েকটি বিকটশব্দ শোনা গেছে। আতঙ্কে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাইশফাঁড়ি হেডম্যানপাড়া এলাকার অনেকে পাশের এলাকায় চলে যান। তবে এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের নিরাপত্তা টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে আস্তানা ও ক্যাম্প দখলের যুদ্ধ চলছে। আরাকান আর্মির আস্তানা ধ্বংসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার থেকেও গোলা বর্ষণ করছে। শুক্রবার তৃতীয় দফায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনী এবং সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে চলমান সংঘাতে তিনটি মর্টারশেল এসে পড়েছিল তুমব্রু সীমান্তে। এর আগে যুদ্ধ বিমান ও মর্টার থেকে ছোড়া গোলা আরও দু’বার এসে পড়েছিল ঘুমধুম সীমান্তের জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। ভারী অস্ত্রশস্ত্রের গুলীও বিভিন্ন সময়ে উড়ে এসে পড়েছে বাংলাদেশ সীমানায়। এ কারণে ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম-তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, রেজু-আমতলী সীমান্তে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় সীমান্তের বাসিন্দাদের অনেকেই পার্শ্ববর্তী এলাকায় আত্মীয়-স্বজনদের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেছেন, নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে কঠোর নজরদারি করছে প্রশাসন। মিয়ানমার থেকে আর কোনো রোহিঙ্গা যাতে আমাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারি করছে, আর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও সর্বোচ্চ সর্তকাবস্থায় কাজ করছে। গতকাল সকালে জেলা প্রশাসক তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সীমান্ত নিয়ে আরও বলেন, সম্প্রতি আমি সীমান্তের পরিস্থিতি পরিদর্শনের জন্য ঘুমধুম, তুমব্রু ও নোম্যান্স ল্যান্ডে ঘুরে এসেছি। আমি যতক্ষণ সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছিলাম, সেখানে কোনো গোলাগুলীর আওয়াজ পাইনি। বর্তমানে আমার মনে হয়, সীমান্ত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। মঙ্গলবার থেকে কক্সবাজারের উখিয়ার কিছু অংশে গোলাগুলীর সংবাদ পাওয়া গেছে। সীমান্তবর্তী জনগণকে সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি একেক সময় একেক রকম হয়ে যাচ্ছে। সীমান্তে যারা বসবাস করছে, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে এবং পরিস্থিতি যদি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের জন্য আমরা ব্যবস্থা করব। ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে বাংলাদেশী ৩০০ পরিবারের বসবাস রয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আমাদের জানিয়েছেন। প্রতি পরিবারে চার থেকে পাঁচজন করে সদস্য রয়েছে এবং প্রতিটি পরিবারই একান্নবর্তী পরিবার আর সীমান্তের অবস্থা যদি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাহলে আমরা আমাদের জনসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তাদের অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করব। গত এক মাস ধরে তুমব্রু সীমান্তের মিয়ানমার অংশে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লড়াই হচ্ছে। দু’পক্ষের সংঘাতে মাঝে মধ্যেই মর্টার শেলের গোলা এবং ভারি অস্ত্রের গুলী এসে পড়ছে বাংলাদেশ ভূখ-ের তুমব্রু সীমান্তে। সীমান্তের এমন পরিস্থিতিতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, রেজু, আমতলী, ফাত্রাঝিরি, চাকমাপাড়াসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। স্থানীয়দের চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বিজিবি, বাড়ানো হয়েছে টহল।
উল্লেখ্য, গত ২৮ আগস্ট মিয়ানমার থেকে ছোড়া দু’টি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে। ৯ সেপ্টেম্বর একে-৪৭ এর গুলী এসে পড়ে তুমব্রু এলাকায়। সর্বশেষ গত শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে স্থলমাইন বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশী যুবক আহত ও রাতে মর্টার শেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা নিহত ও পাঁচ রোহিঙ্গা আহত হন। এরপর স্থানীয়দের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম