প্রশ্নফাঁসে বিজি প্রেসের কর্মচারী নন, জড়িত সরাসরি কেন্দ্র সচিব। তিনি আর কেউ নন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রশ্নপত্র সংরক্ষণের প্রধান দায়িত্ব যার হাতে। অথচ একটি-দুটি নয়, তিনি নিজেই সাতটি বিষয়ের প্রশ্নফাঁস করেছেন। অনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব প্রশ্নের উত্তরপত্র প্রস্তুত করে তা ১৫-২০ হাজার টাকায় বিক্রিও করেছেন। নজিরবিহীন এমন ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারিতে। আলামত জব্দসহ তিনজন শিক্ষককে হাতেনাতে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এ ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে প্রায় সাত বছর বিরতি দিয়ে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা আবারও ধরা পড়ল। শুধু তাই নয়, ভুল করে অন্য বিষয়ের প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করার ঘটনাও ঘটেছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। তবে প্রশ্নফাঁসের এমন ডামাডোলের মধ্যে পরীক্ষা কক্ষের পরিবেশ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আসছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। যুগান্তরের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান, বেশিরভাগ পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষকদের সহায়তায় নকলও চলছে অনেকটা অবাধে। কোথাও পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে সুনসান নীরবতা, কিন্তু কেন্দ্রের ভেতরে চলছে নকল। খোদ শিক্ষকরাই বলে দিচ্ছেন প্রশ্নের উত্তর। এমনকি এমসিকিউ খাতা পূরণ করে দিচ্ছেন কোনো কোনো শিক্ষক। এছাড়া হলের মধ্যে খাতা দেখাদেখির ঘটনা তো একেবারে মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঢালাওভাবে সব পরীক্ষাকেন্দ্রে এমন অবস্থা না থাকলেও সংখ্যাটা একেবারে কম নয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বুধবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা কাকে বিশ্বাস করব। প্রশ্নপত্র আনা-নেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম, শুনলাম উনিই প্রশ্নফাঁস করেছেন। তাহলে কোথায় বিশ্বাস রাখব? ছাত্ররা কী শিখবে? শিক্ষকদের তো আমরা শাসন করতে পারি না। আর এ লজ্জা নিয়েই আমরা আজ এখানে কর্মশালা করছি।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ভুরুঙ্গামারিতে প্রধান শিক্ষক যেটা করেছেন সেটা তার পেশাগত অসদাচরণ। খবরে আরও দেখলাম যে, একজন শিক্ষকের সন্তান পরীক্ষার্থী, কিন্তু তিনি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন। এমন আরও অভিযোগের কথা এবার শুনেছি। দেশে ১০ লাখ শিক্ষক আছেন। তাদের মধ্যে যদি ১০ জনও এমন করেন, সেটা মানুষ গ্রহণ করবে না। তারা সাধারণভাবে বলবেন-শিক্ষকরা অসততা করেন। আসলে এসব শুনলে একজন শিক্ষক হিসাবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে।’ তিনি বলেন, ‘বেশ অনেকদিন ধরেই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। তাই এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে।’
যা ঘটেছে ভুরুঙ্গামারীতে : যুগান্তরের কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও ভুরুঙ্গামারী প্রতিনিধি জানান, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা আলোচনায় আসে ইংরেজি দুই বিষয়ের পরীক্ষার দিনে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তা গণমাধ্যমকর্মীদের নজরে আসে। এরপর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। অনেক নাটকীয়তা শেষে মঙ্গলবার মধ্যরাতে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত তিন শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় ভুরুঙ্গামারী থানায় চার শিক্ষক ও অজ্ঞাতসহ ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তবে ঘটনায় অন্যতম সহযোগী হিসাবে অনেকেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানের নাম বলছেন। যদিও রহস্যজনক কারণে মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি। কেননা, যেসব বিষয়ের প্রশ্নফাঁস হয়েছে সেগুলোর প্যাকেট সিলগালা করা হয়েছে। ওইসব প্যাকেটের ওপর শিক্ষা কর্মকর্তার স্বাক্ষর আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাফাই গেয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি ভুরুঙ্গামারি থেকে কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।’
জানা গেছে, উল্লিখিত কেন্দ্র সচিব এসএসসি পরীক্ষার প্রথমদিনই বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নের সঙ্গে আরও ৭টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র নিয়ে আসেন। যে কারণে পরবর্তী পরীক্ষাগুলোর (বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্র) প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্নপত্র সংগ্রহকালে সেখানে সংশ্লিষ্ট উপজেলার দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার থাকার কথা। নিয়মানুযায়ী তিনি থেকে খাম গণনা করবেন। সেটা করলে প্রশ্নফাঁস সম্ভব হতো না।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে, সুরক্ষিত ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন এনে থেমে থাকেননি কেন্দ্র সচিব ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান। তিনি সহযোগী কয়েক শিক্ষকের সহায়তায় প্রস্তুত করেন উত্তরপত্র। এরপর তা নিজের স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ১৫-২০ হাজার টাকা করে বিক্রি করেন। শুধু তাই নয়, একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা তা ৫শ টাকায়ও বিক্রি করেন। আর এভাবেই তা জানাজানি হয়। এরপর স্থানীয় প্রশাসন মঙ্গলবার ওই শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় আর চার বিষয়ের প্রশ্ন। ওইসব বিষয়ের মধ্যে একটির পরীক্ষা আজ (বৃহস্পতিবার) ছিল। বাকিগুলো আগামী ৩ দিন হওয়ার কথা ছিল। বিষয়গুলো হচ্ছে-গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন। প্রশ্নপত্র উদ্ধারের পরই অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকসহ ইংরেজি শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক জোবায়ের হোসাইনকে আটক করা হয়। এছাড়া বুধবার ভোরে হামিদুল ইসলাম ও সোহেল আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। মামলার অপর আসামি ক্লার্ক আবু হানিফ পলাতক আছে।
এদিকে কুড়িগ্রাম থেকে ঘটনার ওপর বিস্তারিত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদন পৌঁছেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুরুঙ্গামারি থানার সদর ইউনিয়নের কলেজ মোড় থেকে প্রায় ২৫০ মিটার দূরে অবস্থিত নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এর প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের কক্ষ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র উদ্ধার করা হয়। পরীক্ষার উপজেলা পরীক্ষা কমিটি কর্তৃক অভিযোগ পাওয়ার পরে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এর ৪/১৩ ধারায় মামলা (নম্বর ১৯) করা হয়েছে। এতে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণে বলা হয়, মূলত ইংরেজি ২য় পত্রের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় লুৎফর রহমান এবং তার অপরাপর ২ সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। আরেকজন পলাতক আছেন। মামলাটি করেছেন এই পরীক্ষা কমিটির ট্যাগ অফিসার ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আদম মালিক। অন্য তিন আসামি হলেন মো. জুবাইর হোসেন (৪১) পিতা-মৃত আবু বক্কর সিদ্দিক; মো. হামিদুল ইসলাম (৪০), পিতা মো. আকবর হোসেন এবং মো. আবু হানিফ (৪৮), পিতা মৃত বাহার আলী। এদের প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূলহোতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।
এরপরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুসারে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ও রসায়নের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তবে পরীক্ষার নতুন সময় জানানো হয়নি।
শিক্ষক লিখে দিচ্ছেন উত্তরপত্র : অভিযোগ আছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণির শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন বোর্ডের অধীন কিছু কেন্দ্রে দেখাদেখির পরিবেশে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে নেমেছে যে, খোদ শিক্ষক কর্তৃক পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র ভরাট করে দেওয়ার মতো বিস্ময়কর খবরও পাওয়া গেছে। এমন একটি ঘটনায় পটুয়াখালীতে মামলা হয়েছে। জানা যায়, বাংলা প্রথমপত্রের দিন মৌকরণ আবদুল মালেক আকন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট দেখতে পান যে, পটুয়াখালীর পাঙ্গাশিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ছাত্রীদের উত্তরপত্র ভরাট করে দিচ্ছেন। তখন তিনি ওই শিক্ষককে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে এ ব্যাপারে থানায় একটি জিআর মামলা করা হয়েছে। তবে বোর্ড থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি।
তদন্ত কমিটি : ভুরঙ্গামারির ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর মো. ফারাজ উদ্দীন তালুকদারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উমা.) প্রফেসর মো. হারুন-অর রশিদ মণ্ডল এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. আকতারুজ্জামান। কমিটিকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে বড় আকারে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালে। এরপর ২০১৭ সালেও একবার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আসে। তবে ২০১৪ সালের ঘটনা বড় আকারে তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ও বর্তমানে সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন। তার কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ব্যবস্থা অনুযায়ীই বর্তমানে পরীক্ষা হচ্ছিল। কিন্তু সেখানেও দুষ্কৃতিকারীরা ফাঁক-ফোকর বের করে প্রশ্নফাঁস করল।
সোর্স : যুগান্তর