রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার আমদানিতে কড়াকড়ি, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এত সবের পরেও রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে না। বরং বেড়েই চলছে। ফলে রিজার্ভ অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ কমে বুধবার ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলারে নেমে গেছে। অর্থাৎ ৩৭ বিলিয়ন থেকে কমে এখন ৩৬ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে।
আমদানি ব্যয়ের চাপ বাড়ায় রিজার্ভ থেকে প্রতিদিনই বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। যেভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি হচ্ছে, সেভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাবদ ডলার রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না। ফলে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকগুলোতে ডলারের তীব্র সংকট রয়েছে। তার মধ্যেও এর দাম আরও কিছুটা কমেছে। বুধবার আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে গড়ে ১০২ টাকা ৩৭ পয়সা দরে। ওই দিন ডলারের গড় মূল্য ছিল ১০২ টাকা ১৭ পয়সা থেকে ১০২ টাকা ৩৭ পয়সা। আমদানির জন্য ডলারের দামও কমেছে। গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন ব্যাংকে গড়ে ১ থেকে ২ টাকা পর্যন্ত কমেছে। সূত্র জানায়, গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে রিজার্ভ কমতে থাকে। ওই সময় থেকে আমদানি ব্যয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে রিজার্ভ কমতে ছিল। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ কমে ৪ হাজার ৬২০ কোটি ডলারে নামে। অক্টোবরে সামান্য বেড়ে ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি ডলারে উঠে। পরের মাসে নভেম্বরে আবার কমে ৪ হাজার ৪৮৮ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরে সামান্য বেড়ে ৪ হাজার ৬১৫ কোটি ডলারে উঠে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে রিজার্ভ টানা কমতে থাকে। জানুয়ারিতে ছিল ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৪ হাজার ৫৯৪ কোটি ডলার, মার্চে ৪ হাজার ৪১৫ কোটি ডলার, এপ্রিলে ৪ হাজার ৪০২ কোটি ডলার, মে মাসে ৪ হাজার ২২০ কোটি ডলার, জুনে ৪ হাজার ১৮৩ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ৩ হাজার ৯৬০ কোটি ডলার, আগস্টে ৩ হাজার ৯০৬ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ছিল ৩ হাজার ৮৯৪ কোটি ডলার। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেশগুলোর জুলাই-আগস্টের দেনা বাবদ ১৭৪ কোটি ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩ হাজার ৭১৩ কোটি ডলারে নেমে আসে। এরপর থেকে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সামান্য উপরে অবস্থান করছিল। কিন্তু রিজার্ভ থেকে আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলার বিক্রি অব্যাহত ছিল। যে কারণে রিজার্ভ কমে বুধবার ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। এ দিন রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলার।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ১ বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ১৬৩ কোটি ডলার।
এদিকে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমদানি ব্যয় মেটাতে ৬ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে। ৯৬ টাকা দরে এই ডলার বিক্রি করেছে। ওই ডলার বিক্রির পর রিজার্ভ ৩ হাজার ৬৯৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আকুর দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ সর্বনিু ৩ হাজার ৭১২ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ কমেছে ১৬ কোটি ডলার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাধারণত কোনো দেশের ৩ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য রিজার্ভ থাকলে তা আদর্শ ধরা হয়। বর্তমানে দেশের রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা সম্ভব। সুতরাং রিজার্ভ নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এছাড়া সরকার আমদানিতে কড়াকড়ি ও কৃচ্ছ্রসাধন নীতি ঘোষণা করছে। এতে আমদানি কমতে শুরু করেছে। আবার রপ্তানি আয় বাড়ছে। পাশাপাশি সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে রেমিট্যান্স সংগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর করোনার পরে গত দেড় বছরে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে রেমিট্যান্স সংগ্রহ আরও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ। আগস্টে এলসি বাবদ পরিশোধ হয়েছে ৫৯৩ কোটি ডলার, যা আগের মাসে ছিল ৭৪২ কোটি ডলার।
করোনার সময়ে এলসির দেনা স্থগিত করায় সেগুলো এতদিন পরিশোধ করতে হচ্ছিল। যে কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছিল। এখন বকেয়া আমদানি ব্যয় মেটানোর চাপ কিছুটা কমেছে। চলতি আমদানি ব্যয়ও কমছে। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপও কমবে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা।
এদিকে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম বেশ কমে এসেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা ৯০ পয়সায় উঠেছিল। এখন তা কমে বুধবার গড়ে ১০২ টাকা ৩৭ পয়সায় নেমে এসেছে। আগের দিন মঙ্গলবার ১০১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ১০২ টাকা ৫৬ পয়সা দরে প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে আমদানির জন্য ডলারের দামও কিছুটা কমেছে। সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক মঙ্গলবার ১০৫ টাকা ৮৫ পয়সার পরিবর্তে ধুববার বিক্রি করেছে ১০৫ টাকা ৪৭ পয়সা দরে। রূপালী ব্যাংক ১০৬ টাকা ৯৫ পয়সার পরিবর্তে বুধবার ১০৬ টাকা ৬৫ পয়সা দরে বিক্রি করেছে। অগ্রণী ব্যাংক ১০৩ টাকা ৯৫ পয়সার পরিবর্তে বুধবার ১০৩ টাকা ১৫ পয়সা, জনতা ব্যাংক ১০৫ টাকা ৫ পয়সার পরিবর্তে বুধবার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে।
বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংকে ১০৩ টাকা অপরিবর্তিত রয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ১০৬ টাকা ৯০ পয়সার পরিবর্তে বুধবার ১০৬ টাকা ৩১ পয়সা দরে, এবি ব্যাংক ১০০ টাকা ৭৬ পয়সার পরিবর্তে ১০০ টাকা ৫৮ পয়সা দরে, ইউসিবি ১০২ টাকা ৬০ পয়সার পরিবর্তে বুধবার ১০১ টাকা ৬৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। এভাবে প্রায় সব ব্যাংকেই ডলারের দাম কিছুটা কমছে।
এদিকে বাজারে ডলার সংকট এখনও কাটেনি। ব্যাংকগুলো করপোরেট সেলের আওতায় ৩ মাস বা ৬ মাস মেয়াদি আগাম ডলার ১১২ টাকা থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে।
সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বৈঠকে বসে ডলার বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। তারপর তারা এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
সোর্স : যুগান্তর