মাঝখানে করোনার কারণে কিছুদিন কিছুটা কমে গেলেও সম্প্রতি আবারও যানজটে স্থবির হতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকা। আবারও ১০-১৫ মিনিটের দূরত্বের গন্তব্যে পৌঁছাতে দু’-আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত তো বটেই, কোনো কোনো এলাকায় তার চাইতেও বেশি সময় লাগছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ভোগান্তির প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হওয়া এই যানজট নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র রিপোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শত শত গাড়ির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাসহ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের বিবরণ যেমন থাকছে তেমনি থাকছে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথাও। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যানজট সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানানো হচ্ছে না। ফলে মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের অবসান হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
দু’দিন আগে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার, রাজধানী ঢাকা আবারও ফিরে গিয়েছিল নিজের সেই পুরনো অবস্থায়। সেদিন সকাল থেকেই স্থবির হয়ে পড়েছিল মহানগরী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও সরকারি-বেসরকারি টেলিভেশনে দেখানো বিভিন্ন রিপোর্টে আবারও হাজার হাজার গাড়ি ও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথাও এসেছে এসব রিপোর্টে। বড়কথা, সকালে শুরু হলেও দূর অতীতের মতো ‘অফিস টাইম’ পর্যন্তই শুধু নয়, ‘অফিস টাইম’ পেরিয়ে সন্ধ্যার পর, এমনকি গভীর রাত পর্যন্তও মানুষকে এই যানজটের শিকার হয়ে কষ্ট করতে হয়েছে।
দফায় দফায় বৃষ্টি হওয়ার ফলেও মানুষ কোনো বাস বা যানবাহন থেকে নেমে পড়তে এবং কিছু দূর পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গাড়ির ভেতরে জিম্মি অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। এসব বিষয়ে সংক্ষেপে হলেও সংবাদপত্রের রিপোর্টে যে বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো শুধু আশংকাজনক নয়, যে কোনো বিচারে যথেষ্ট ভীতিকরও।
একযোগে আবারও যানজটের কারণ সম্পর্কিত আলোচনা শুরু হয়েছে। কেবলই যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এবং ট্রাফিক পুলিশের অব্যবস্থাপনার কারণে নয়, মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের কার্যক্রমকেও যানজটের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে। এ যেন ‘চলছে তো চলছেই’ ধরনের অবস্থা! প্রধান সড়কগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করে মাঝখানের অংশে মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে বলে রাজধানীর বিরাট এলাকাজুড়ে সড়কগুলো সংকুচিত হয়ে গেছে আর যানবাহনের প্রচন্ড চাপে স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো রাজধানী। মঙ্গলবারও একই অবস্থা হয়েছিল।
ফার্মগেট থেকে মতিঝিল যাওয়ার পথে শত শত যানবাহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছে একই স্থানে। কিন্তু এত কিছুর পরও সরকারের পক্ষ থেকে কাজ দ্রুত সমাপ্ত করার কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। উদ্বেগের কারণ হলো, কিছুদিন আগে পর্যন্তও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে হবে বলে শুনিয়ে আসার পর বছরের শেষভাগে জানানো হয়েছিল, মেট্রোরেল চালু নাকি হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে! সেটাও আবার নাকি হবে পরীক্ষামূলকভাবে! বলা হচ্ছে, কথাটার মধ্য দিয়ে আসলে আবারও সময় বাড়ানোর জন্য ফাঁক রাখা হয়েছে। অর্থাৎ চলতি বছরের ডিসেম্বরেও মেট্রোরেল চালু হচ্ছে না!
বলা দরকার, মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের নামে রাজধানীকে স্থবির করে ফেলার কর্মকা- সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এর কারণ, মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য মহানগরীর বিভিন্ন অংশে কয়েক বছর নষ্ট করা হয়েছে। মেট্রোরেলের জন্যও একইভাবে নষ্ট হচ্ছে মাসের পর মাস। আশংকা ও আপত্তির কারণ হলো, যে গতিতে নির্মাণ কাজ চলছে কোনো দেশের রাজধানীতে অমন ধীর গতিতে এত বিরাট ধরনের নির্মাণ কাজ চালানো যায় না। চালানো হয়ও না।
আমরা উদ্বিগ্ন আসলে মানুষের ভোগান্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক এক গবেষণা রিপোর্টে জানিয়ে রেখেছে, তীব্র যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন মানুষের ৩২ লক্ষ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর অর্থের দিক থেকে প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার। সে হিসেবে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮৪ কোট টাকা। যানজটের ফলে রাজধানীতে যে গাড়ির গতি অনেক কমে গেছে- সে কথাও জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে রেখেছেন, অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো গেলে ২০২৫ সালে ঢাকায় যানবাহনের গতি কমে ঘণ্টায় মাত্র চার কিলোমিটারে নেমে আসবে। তখন মানুষ হেঁটেই যে কোনো যানবাহনের চাইতে কম সময়ে বেশি দূরে যাতায়াত করতে পারবে।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণা রিপোর্টটি গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল বলে সে সময় জরুরি ভিত্তিতে রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান করার জন্য দাবি উঠেছিল। অন্যদিকে সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরিবর্তে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের মতো এমন সব কর্মকা-েই সরকার ব্যস্ত হয়েছে, যেগুলোর কারণে মাসের পর মাস তো বটেই, বছরের পর বছর ধরেও রাজধানীবাসীকে প্রচন্ড কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আমরা এমন অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই এবং মনে করি, সরকারের উচিত মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের কাজ দ্রুত সমাপ্ত করা এবং যানজটের প্রাত্যহিক ক্ষয়ক্ষতি ও যন্ত্রণা থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়া।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম