চলমান কিছু ঘটনার খণ্ডচিত্র নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে দেশের পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। একটি হলো উত্তর-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমারের অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে টহল দেয়া ও গোলা বর্ষণ করা। বারবার এ ধরনের ঘটনার পর সীমান্ত এলাকা থেকে ৩০০ পরিবারকে দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পরপর দ্বিতীয় দিনের মতো ঘোষণা দেন যে, ‘বাংলাদেশ কোনোভাবেই মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না, প্রয়োজন হলে ইস্যুটি নিয়ে আমরা জাতিসঙ্ঘে যাব। আমরা শান্তিকামী নিরীহ জাতি, যুদ্ধে জড়াতে চাই না।’
এই নীতির অংশ হিসেবে সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলায় কোনো সামরিক প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। কেবলই বলা হচ্ছে, বর্ডার গার্ডকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করছেন, বাংলাদেশ সরকারকে কি কোনো যুদ্ধভীতি তাড়া করছে? মিয়ানমারের অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সীমান্ত পেরিয়ে গোলা বর্ষণ আর সীমান্তের ওপারে বাংকার খনন করে আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করার পর সরকার দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কেবল কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। বলা হয়েছে, শেষবার ক্ষোভের মাত্রার প্রকাশ ঘটাতে বর্মি দূতকে চা-ও অফার করা হয়নি। মিয়ানমারের জান্তা এরপর সার্জিক্যাল অ্যাটাকের মতো কিছু করে বসলে হয়তো পঞ্চমবারের মতো দূতকে তলব করা হবে, আর এবার হয়তো চেয়ারে বসতেও বলা হবে না।
আর যেহেতু আমরা কোনোভাবেই যুদ্ধ চাচ্ছি না এরপর আরাকান আর্মি তাড়ানোর নাম করে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে মিয়ানমার বাহিনী কিছু এলাকা দখল করে নিলেও আমরা হয়তো দূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদই জানাব, আর সেইসাথে আগ্রাসী শক্তিকে ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলব, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে ‘আমরা জাতিসঙ্ঘে যাব’।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আগ্রাসী আচরণে আমরা যখন ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চলেছি তখন দেশের ভেতরের আরো একটি খণ্ডচিত্র আমাদের বেশ আলোড়িত করছে। বাংলাদেশের কার্যত বিরোধী দল বিএনপি এদিন বনানীতে একটি কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। এটা রাজপথ দখল করে সরকারের পতন ঘটানোর মতো কর্মসূচি ছিল না। ছিল মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদের নিরীহ কর্মসূচি।
এই কর্মসূচি আয়োজনকারীদের ওপর এমন বেপরোয়া হামলা চালানো হয়েছে যে, সেলিমা রহমানের মতো একজন প্রবীণ মহিলা নেত্রীকে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছে। তাবিথ আউয়ালের মতো শান্ত সজ্জন যুবনেতার মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে।
কেন এমনটি হচ্ছে? আমরা কি গণতন্ত্রহীনতার কোনো বিপদই দেখছি, যে বিপদ একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতাকে পর্যন্ত হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। গণতন্ত্রের এই ঘাটতি প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রওনক জাহানের বক্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে আমি যে নেতিবাচক দিকটাকে আবারও গুরুত্ব দেবো, সেটা হলো সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাওয়া। সেটা শুধু ধর্মের জায়গা থেকে নয়, রাজনৈতিকভাবেও ভিন্নমত পোষণকারীদের বিষয়ে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটছে।
কথাটা হচ্ছে যে, ‘সংখ্যালঘুর সম্মতির ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলো গণতন্ত্র।’ কিন্তু সংখ্যালঘু ও তাদের ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেলে আর গণতন্ত্র থাকল না। (প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকার; ২৬ মার্চ ২০২০)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় অঙ্গীকার করা হয়েছে যে, ‘এ রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।’ সংবিধানে ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।’ আর এজন্যই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সর্বস্তরে ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের’ শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল তৃণমূলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণতা দেয়া এবং এর ভিতকে শক্তিশালী করা।
প্রশ্ন হলো, সংবিধানের এই বিধান অনুসারে বাংলাদেশে এখন কি আসলে কোনো গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে? গত ফেব্রুয়ারিতে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত ২০২১ সালের সর্বশেষ গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ৭৫তম। ২০২১ সালে ১০ স্কেলে বাংলাদেশ ৫.৯৯ স্কোর করেছিল, যা ২০২০ সালের সমান। এই স্কোরের সাথে, বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড শাসনের’ মধ্যে রাখা হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সংজ্ঞা অনুসারে, হাইব্রিড শাসনের মধ্যে পড়ে থাকা দেশগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন রোধে যথেষ্ট অনিয়ম প্রদর্শন করে। এ ধরনের দেশে আইনের শাসন দুর্বল, দুর্নীতির মাত্রা বেশি, সুশীলসমাজ দুর্বল এবং সাধারণত সাংবাদিকদের হয়রানি ও চাপ দেয়া হয় এবং বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়।
ফ্রিডম হাউজের ২০২১ সালের সূচকে আমাদের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ৩৯, যা ২০১৬ থেকে ৫ পয়েন্ট কম। এই স্কোর অর্জনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে স্কোর ছিল ৪০ এর মধ্যে ১৫, আর নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে স্কোর ছিল ৪০ এর মধ্যে ২৪, সর্বমোট ৩৯। ফ্রিডম হাউজের মতে, বাংলাদেশে বিএনপি এবং তার মিত্র বলে পরিচিত ও সমালোচনাকারী গণমাধ্যমকে অব্যাহতভাবে হয়রানি এবং নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সমস্যা এবং দুর্নীতি দমনকার্যক্রম রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেকটা অকার্যকর। ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুর্বলতা রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিনা দ্বিধায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে।
সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মূল্যায়নে, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার আজ চরমভাবে লঙ্ঘিত। আইনের শাসন নগ্নভাবে পদদলিত। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা বহুলাংশে তিরোহিত। লুণ্ঠন ও বঞ্চনা সর্বত্র। ভোটাধিকার অপহৃত। এক কথায়, গণতন্ত্রহীনতার এক নির্লজ্জ উল্লাস যেন আজ চার দিকে। আর বর্তমানের এ দুঃসহ পরিস্থিতি কিন্তু সাঁজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে একদল সামরিক উর্দি পরা ব্যক্তি ট্যাঙ্কে চড়ে এসে সৃষ্টি করেনি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সুবিধা নিয়েই মানুষের ভোটের মাধ্যমেই অর্থাৎ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফলভোগী হিসেবেই, দিনবদলের অঙ্গীকার করে, বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া দল ১২ বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিল। দল তখন অঙ্গীকার করেছিল, মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনবে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটাবে। দলীয়করণে লাগাম টানবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। মানবাধিকার সমুন্নত রাখবে। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তুলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকর ও শক্তিশালী করবে। আয়-সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য দূরীভূত করবে। সর্বোপরি একটি সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন।’ (ড. বদিউল আলম মজুমদার; গণতন্ত্রহীন উন্নয়নের পরিণতি অশুভ; মানবজমিন; ২৬ মার্চ ২০২১)
গণতন্ত্রের ক্ষয় সম্পর্কে আলী রীয়াজের বক্তব্যটি বেশ গভীর। তিনি বলেছেন, এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্রের যাত্রা মসৃণ ছিল না। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের সূচনায় গণতন্ত্রের মৌলিক যে বিষয়গুলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং শাসনের যে তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশে নির্বাচনী গণতন্ত্রের উপস্থিতির কথা বলতে পারতাম, গত এক দশকে তার প্রবল ক্ষয় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ‘নির্বাচন’ তার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ। এই দুই নির্বাচন একাদিক্রমে জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহির ধারণাকেই লঙ্ঘন করেছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রায়-তিরোহিত হয়েছে, সমাবেশের অধিকার এখন নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছানির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু এর বাইরেও যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, গোটা শাসনব্যবস্থা এবং ক্ষমতাসীনেরা এখন আর ‘সম্মতি’র জন্য সচেষ্ট নয়। তার বিপরীতে শক্তি প্রয়োগের ওপর তার নির্ভরশীলতা। এগুলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের লক্ষণ এবং রাষ্ট্রের ভেতরে শক্তি প্রয়োগকারী বাহিনীর আধিপত্যের প্রমাণ দেয়। ফলে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি এবং গণতন্ত্রাকাক্সক্ষী শক্তিকে গণতন্ত্রের এসব মৌলিক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে, তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে হবে। (বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থা বিচার করব কীসের মানদণ্ডে/ আলী রীয়াজ, প্রথম আলো অনলাইন, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)
এখন গণতন্ত্র আর উন্নয়নকে মুখোমুখি নিয়ে আসা হয়েছে। গণতন্ত্রবিবর্জিত উন্নয়নপ্রচেষ্টা গণতন্ত্রহীনতার সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি তথা সুষ্ঠু নির্বাচনই নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে প্রেরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেললে, অনিয়মতান্ত্রিক ও অশান্ত, এমনকি সহিংস পথে ক্ষমতার রদবদলের পথ প্রশস্ত হয়। আর তাতে কারো নিরাপত্তাই নিশ্চিত থাকে না। তাই উন্নয়নের নামে এবং অজুহাতে মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে কার্যকর বিরোধী দলের শূন্যতা দেখা যাচ্ছে তা বুমেরাং হয়ে জাতি হিসেবে আমাদের এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
লেখার শুরুতে বাংলাদেশ যে প্রতিবেশী দেশটির সর্বশেষ আগ্রাসনের শিকার হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে, সেই দেশটির দৃষ্টান্ত আমরা বিবেচনা করতে পারি। বাংলাদেশের এই ভূখণ্ড ১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে। আর মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। বাংলাদেশ ও এর পূর্বসূরি পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও বহু মতের চর্চা নিরবচ্ছিন্নভাবে না চললেও গণতন্ত্র চর্চার একটি মিশ্র ইতিহাস রয়েছে। অন্য দিকে মিয়ানমার হঠাৎ গণতন্ত্র চর্চার কিছু প্রচেষ্টা ছাড়া একনায়কের শাসনে মোটামুটি পৌনে এক শতাব্দী পার করেছে। এর পরিণতি কী হতে পারে তা এখন দেখতে পাচ্ছি আমরা।
মিয়ানমারের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটি এখন ক্ষতবিক্ষত। দেশটির ৫২ শতাংশের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রতিদিনই বিদ্রোহী সেনাদের হাতে নিহত হতে হতে এখন সেনাসদস্যরা নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতেও অনীহা প্রদর্শন করছে। এক সময় জাতিগত সংখ্যালঘুরা বার্মায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সঙ্ঘাতে যুক্ত ছিল, এখন রাখাইন চিন সাগাইন কাচিন, শান, ওয়াহ স্টেটের বিদ্রোহীদের সাথে মূল ধারার বার্মার জাতিগোষ্ঠীও জান্তাবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে। জান্তা শাসন অব্যাহত থাকলে মিয়ানমার চার খণ্ডে ভাগ হয়ে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। চীনের মতো জান্তাশাসনের দীর্ঘকালীন পৃষ্ঠপোষকও সেনা শাসকদের সাথে এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি করে এখন গণতান্ত্রিক সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
অব্যাহত গণতন্ত্রহীনতার পরিণামে মিয়ানমারে হয়তো আরেকটি উত্তর কোরিয়া হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক শক্তি অর্জনের জন্য মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান রাশিয়ার সাথে চুক্তিও করেছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু জাতীয় আয় এখানকার মতো ১০০ ডলারের কোটায় ছিল। এখন দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু জাতীয় আয় ২৩ হাজার ডলার। আর মাথাপিছু জাতীয় আয় উত্তর কোরিয়ার ১৩ শ’ ডলার আর বাংলাদেশের আড়াই হাজার ডলারের কিছু বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নের এই অবস্থার পেছনে অন্য অনেক ফ্যাক্টর কাজ করলেও এর প্রধান কারণ হতে পারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চর্চা। দক্ষিণ কোরিয়া একটি মুক্ত গণতন্ত্র চর্চা ও মুক্তবাজারব্যবস্থার দেশ। আর বিপরীতে উত্তর কোরিয়া হলো বিশ্বের অন্যতম প্রধান একনায়ক শাসিত দেশ। বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো এখন এ দুইয়ের মাঝামাঝি।
সাধারণভাবে যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে কূটনৈতিক অংশীদাররা চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে রোহিঙ্গা সঙ্কট আজকের অবস্থায় নাও পৌঁছতে পারত। বৈধতার সঙ্কটে থাকা সরকার বিনিয়োগ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অন্যদের সুবিধা দিয়ে সমঝোতা করে। বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পগুলোতে অন্য দেশের তুলনায় প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ হওয়ার পেছনে এটি কাজ করেছে। করোনার পরে ইউক্রেন যুদ্ধের বৈরি পরিস্থিতির সাথে প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় আর বিদ্যুৎ না নিয়ে ৯ মাসে ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করার মতো অপচয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে বৈদেশিক খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়। ডলারের দামে আকস্মিকভাবে উল্লম্ফন ঘটতে থাকে। এর পাশাপাশি আর্থিক ও ব্যাংক খাতে যে সঙ্কটের আশঙ্কা অর্থনীতিবিদরা করছেন তা বাস্তবিকই বিপজ্জনক।
এর সাথে সীমান্তে মিয়ানমারের আগ্রাসী আচরণ সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করতে পারে। এ ধরনের সঙ্কট উত্তরণে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। আর জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজন একটি অবাধ বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন।
জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের বিশ্বসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। এ কারণে গণতন্ত্র চর্চা এবং মুক্ত বিশ্বের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণের প্রচেষ্টা নিতে হবে বাংলাদেশকে। তাহলে যেকোনো আগ্রাসনের মুখে বাংলাদেশ কৌশলগত সহায়তা দেয়ার মতো মিত্র পাবে। ২৪ দেশের সেনাকর্মকর্তারা কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে সেই বার্তাই দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, সেই বার্তা পাঠ করতে আমরা কতটা সক্ষম হচ্ছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংশয়ী পথিকের গন্তব্যে পৌঁছা সব সময়ই কঠিন।
mrkmmb@gmail.com
সোর্স : নয়া দিগন্ত