অস্থিরতা নিয়ে আমাদের বসবাস। যত অস্থিরতা তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বহুল উচ্চারিত এ স্লোগান মানুষ ভুলেছে বহু আগে। সড়ক-মহাসড়কে সতর্কতা বলতে কিছু নেই। যাচ্ছেতাই যাতায়াতের বাড়াবাড়ি সবখানেই। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখা যায়, মৃত্যুকূপে পরিণত দেশের সড়ক-মহাসড়ক। গত আগস্ট মাসে সড়কে ৪৫৮টি দুর্ঘটনায় ঝরেছে ৫১৯ জীবন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে গবেষণা-জরিপে যেসব চিত্র উঠে এসেছে তা আতঙ্কিত হবার মতো।
২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় সাড়ে ৬ হাজার, যা ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। প্রতিবছর দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লাশের সারি। সম্প্রতি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মায়ের পেট ফেটে বাচ্চা বের হবার ঘটনা ব্যথিত করেছে গোটা জাতিকে। একই পরিবারের একাধিক কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিবারের প্রায় সবাইকে একসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতেও দেখা যায়।
পরিসংখ্যান মতে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব। সড়কে রক্ত ঝরবার কারণ শৃঙ্খলার অভাব। সড়কজুড়ে নানা অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রাস্তায় চলাচলকারীদের অসতর্কতাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। পরিস্থিতি এমন যে, কারুর যেন অপেক্ষার ফুরসত নেই। না চালকের, না পথচারীর। রাস্তায় নামলে লাগামহীন হয়ে পড়ছেন সবাই। বেসামাল গতি ছুটিয়ে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াবার সংস্কৃতি চালু হয়েছে যেন। বিশেষত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে নতুনরা। মোটরসাইকেলে চেপে নানা কসরত দেখাবার এক উদ্দাম খেলায় মেতে উঠছে তারুণ্য। তারা ভুলতে বসেছে জীবন তো একটাই। তারুণ্যের উষ্ণ রক্তস্রোতে গা ভাসিয়ে নিজের ও পরিবারের সর্বনাশ করতে দ্বিধা করছে না তারা। যাতায়াতের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তুলতে মোটরসাইকেলের রয়েছে ইতিবাচক ভূমিকা। পাশাপাশি এ বাস্তবতাকেও পাশ কাটাবার উপায় নেই যে, মোটরসাইকেল আমাদের সমাজে এখন অনেকটা মরণসাইকেলে পরিণত হয়েছে। তাই বলতে হয়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় রয়েছে অভিভাবকদেরও।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্নেহ-ভালোবাসা ও আবেগের বশবর্তী হয়ে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দেয়া হচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের হাতে। আবেগের এ আতিশয্যে অকালে ঝরে পড়ছে আদরের সন্তানের জীবন। পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের প্রথম দিনেই সেতুতে দুর্ঘটনা ঘটে। পরপর কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলে পদ্মাসেতুতে সাময়িক মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মনে রাখতে হবে, গুটিকতক অসচেতন, বেপরোয়া, খেয়ালি মানুষের কারণে স্বপ্নের পদ্মাসেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রাখা ঠিক নয়।
সড়ক দুর্ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলেছে। সড়কে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক দুর্ঘটনায় কি জীবনবিনাশ হচ্ছে কেবল? কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বার মতো বিষয় হচ্ছে সড়কদুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে চল্লিশ হাজার কোটি টাকার মতো। এর ফলে ২ থেকে ৩ শতাংশ জিডিপি হারাচ্ছে দেশ। শুধু অসচেতনতা, অসতর্কতার কারণে কী বিশাল মাশুল গুনছে জাতি! উন্নত অনেক দেশের সরকার, নাগরিক যাতায়াতব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। অথচ আমাদের আজও শৃঙ্খলার সংস্কৃতি গড়ে উঠলো না। সড়কশৃঙ্খলার ব্যাপারে আমরা রয়েছি অনেক পেছনে। প্রতিবছর ক্রমাগতভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কি আগের বছরের তুলনায় বাড়তেই থাকবে; নাকি ব্যবস্থাপনা, সচেতনতা-সতর্কতা তথা শৃঙ্খলার সংস্কৃতি লালনে আমরা মনোযোগ দেবো? তরুণদের জীবনের মূল্য কি কোনও গুরুত্ব পাবে না? এভাবে কেবল ঝরেই পড়বে সড়কে?
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম