প্রতিদিন রাজধানীজুড়ে যানজটের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। অসহনীয় যানজট ও বৃষ্টির কারণে গতকাল বুধবার রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই যাত্রী দুর্ভোগ ছিলো সীমাহীন। সড়কগুলোতে উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় বেশ কয়েকটি সড়কে জমেছে বৃষ্টির পানি। খানাখন্দে পানি জমে থাকার কারণে যানজটের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। বৃষ্টির পানি নামতে না পারায় পানিবদ্ধতার কারণে যানবাহনগুলোকে ধীরগতিতে চলতে হয়। একই স্থানে যানবাহনগুলোকে বসে থাকতে থাকতে পুড়ছে জ্বালানি তেল। কিন্তু যেতে পারছে না নির্দিষ্ট গন্তেব্যে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে অফিসগামী ও কর্মব্যস্ত মানুষেরা ঘর থেকে বের হলেও যানজটে পড়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিমানবন্দর-গাজীপুর রুটের যানজটের তীব্রতার করণে ভোগান্তিতে পরতে হচ্ছে রাজধানীর অন্য এলাকার বাসিন্দাদেরকেও।
কর্মজীবী যারা নিত্যদিন বাসে যাতায়াত করেন তারা বলছেন, যানজট এখন আর সাধারণ ভোগান্তি না। এই যানজটের কারণে এক কিলোমিটার পথ যেতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। প্রায় সব প্রধান সড়কেই স্থবির হয়ে বসে থাকে গণপরিবহনগুলো। প্রতিদিন যানজটের কারণে নগরবাসীর আর্থিক যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি সময় ব্যয় হচ্ছে অনেক। নগরবাসীকে কোনো কাজে বের হলে দ্বিগুণ-তিনগুণ সময় লাগছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নগরবাসী।
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে যনচলাচল ধীর গতি ছিল। এছাড়া ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে যান চলাচল বেশ ধীর গতি থাকায় রাজধানীতে যানজট তৈরি হয়েছে। বিমানবন্দর এলাকায় তীব্র যানজটের কারণে সব রাস্তায় গাড়ি ধীর গতিতে চলেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর যানজটে শুধু মানুষের ভোগান্তি ও কর্ম ঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ও। আর অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব যুক্ত হলে এ ক্ষতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। এছাড়া যানজটের এ ক্ষতির সঙ্গে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই হিসাব যোগ করলে এ খরচ বেড়ে আরও দ্বিগুণ হবে। ঢাকার যানজটের কারণে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে। অর্থনীতির এ ক্ষতিকে আরও বড় করে তুলেছে রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণ। এ গবেষণায় নগরের অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এছাড়া দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে শুধু ঢাকায়।
গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কে গত কয়েকদিন ধরে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। গতকাল বুধবার সকল থেকে বাড়তে থাকে যানজট। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যানজটও বাড়ে। অনেকেই ধারণ করেছেন আস্তে আস্তে এর তীব্রতা কমবে। কিন্তু না কমে বরং দিনব্যাপী ছিলো এ রুটের যাত্রীদের কষ্ট। কোন যাত্রীই নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে যেতে পারেননি। তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিমানযাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে। বিদেশগামী যাত্রীদের সাথে আসা আত্মীয়স্বজনরা যেন দুর্ভোগে কাহিল হয়ে পড়েছেন। রাস্তায় যানজট থাকার কারণে গাড়ি নিয়ে সঠিক সময়ে আসতে পানেননি অনেক যাত্রী। অনেকেই আবার গাড়ি থেকে নেমে বিদেশগামী যাত্রীর ব্যাগ মাথায় নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে ছুটতে দেখা গেছে। অনেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট মিস করছেন। যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
দেশের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম বিমানবন্দরটি প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী ও আত্মীয়স্বজনরা আসেন। কেউ কেউ তাদের প্রিয়জনদের বিদেশে যাওয়ার জন্য বিদায় দেন। আবার কেউ কেউ দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরেন। এছাড়াও এই বিমানবন্দর দিয়েই দেশে আসেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, কূটনৈতিকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। তাই এই বিমানবন্দর রোডের অবস্থা নাজুক থাকলে দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
এছাড়া বৃষ্টির কারণে গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী গণপরিবহনসহ যানবাহনের চলাচলে রয়েছে অনেক ধীরগতি। কারণ গাজীপুরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের চলমান রয়েছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ। কিন্তু মামলার কারণে নির্মাণকাজ আপাতত বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এদিকে নির্মাণ সামগ্রীসহ সড়কের রাখা হয়েছে। এছাড়াও সড়কের কাজ অসম্পূর্ণ থাকার কারণেই ভারী যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর অধিকাংশ সড়কেই যানজট ছিলো। মালিবাগ, মগবাজার, মহাখালী, বনানী, খিলক্ষেত, উত্তরা, আব্দুল্লাপুর, টঙ্গী, গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে তীব্র যানজট দেখা গেছে।
বিমানবন্দর রোডে ছিলো প্রচন্ড যানজট। কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় কুড়িল-মালিবাগ সড়কে দেখা গেছে তীব্র যানজট। ফ্লাইওভারের নিচে দীর্ঘ গাড়ির লাইন দেখা গেছে। বনানীর স্টাফ রোড এলাকার ফ্লাইওভারের উপরে ও নিচে ছিলো তীব্র যানজট। এসব এলাকার সিগন্যাল পার হতেই লেগেছে দীর্ঘসময়। প্রাইভেটকার, বাস ও বিআরটিসির বাসগুলোকে যানজটে পড়ে আটকে রয়েছে অনেকক্ষণ। রেডিসনের সামনে গাড়িগুলোতে একঘণ্ট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কোনো দিকে নড়াচড়া করতে পারছে না। দুই দিকের গাড়িই একই সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গী থেকে ঢাকাগামী সড়কে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত রয়েছে ভারী যানজট। আব্দুল্লাহপুর থেকে জসিমউদ্দিন মোড় পর্যন্ত যানবাহনের চাপ কিছুটা কম। কিন্তু জসিমউদ্দিন রোড থেকে বিমানবন্দর এর মাঝখানের ইউটার্ন এলাকায় গাড়ির চাপ অনেক বেশি দেখা গেছে। এখানে এসে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারগুলোকে ইউটার্ন নিতে হয় তাই এখানে গাড়ির জটলা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও কাওলা যেতে দেখা গেছে যানবাহনের সারী।
বিমানবন্দর থেকে শুরু করে খিলক্ষেত, রেডিসন হোটেলের সামনে দিয়ে বনানী-কাকলী থেকে মহাখালী হয়ে সাতরাস্তা, মগবাজার, খিলক্ষেত, কুড়িল হয়ে নতুনবাজার, বাড্ডা, রামপুরা হয়ে মালিবাগ, কাকড়াইল পর্যন্ত ভারী যানজট দেখা গেছে। বিজয় স্মরণী থেকে শেওড়াপাড়া হয়ে মিরপুর-১০, পর্যন্ত, মিরপুর-১০ থেকে পল্লবী হয়ে কালশি পর্যন্ত তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। কল্যাণপুর থেকে আসাদগেট হয়ে মিরপুর সড়কের সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট পর্যন্ত যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ ছিলো।
সৌখিন পরিবহনের যাত্রী কামরুল ইনকিলাবকে বলেন, মহাখালী থেকে বিমানবন্দর আসতে সময় লেগেছে চার ঘণ্টা। এখন স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় যানজট কতটা বেশি ছিলো। যানজটের জন্য রাজধানীতে থাকতে আর ভালো লাগছেনা। এছাড়া এই সড়কে উন্নয়নের নামে প্রকল্পের লোকজন রাস্তা কেটে রেখেছে। এসব স্থানে পানি জমেছে। গাড়ি যেতে হয় হেলেদুলে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দেকা যা অনেক। আর বিআরটি প্রকল্পের লোকজন একবারও চিন্তা করে না যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। দৈনিক হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। যাত্রীদের কথা তারা চিন্তাই করে না।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কের বিভিন্ন স্থানে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এদিকে যানজটের সমস্যা ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরে সমস্যা বেশি। সেখানে যানজটের সৃষ্টি হলে ঢাকাণ্ডময়মনসিংহ সড়কে যানজটের তীব্রতা বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে পুরো রাজধানী জুড়ে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক (উত্তরা) বিভাগের উপকমিশনার নাবিদ কামাল বলেন, গাজীপুরের মিল গেট এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা ভাঙা। তার মধ্যে পানি জমে যাওয়ায় গাড়ি পাস হচ্ছিল না। যে কারণে যানজট হয়েছে, সেটার জের রাজধানীতে ছড়িয়েছে।
ডিএমপির গুলশান ট্রাফিক বিভাগের মহাখালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আশফাক বলেন, গাজীপুরের সমস্যার কারণে সৃষ্ট যানজট বনানী পার হয়ে যায়। রাস্তায় যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ। মাঝে মধ্যে থেমে থেমে একটু যানবাহন চললেও সকাল থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ই রাস্তা স্থবির হয়ে পড়ে।
উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের বিমানবন্দর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সাখাওয়াত হোসেন সেন্টু বলেন, উত্তরার দিকে কোনো গাড়ি এগোতে পারছে না। ফলে বিমানবন্দর এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গাজীপুরের সমস্যার সরাসরি চাপ এসে বিমানবন্দর রোডে পড়ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, সাধারণত কোনো শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে, যেন একটি ড্রেনেজ ব্যবস্থা দিয়ে বছরের পর বছর পার করে দেয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে কাজটি করা হয় অস্থায়ীভাবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাটি এক বছর বা একটি বর্ষা পার করার উপযোগী করে তৈরি করা হয়। আবার ঢাকার বেশির ভাগ ড্রেন তৈরি করা হয়েছে রাস্তার মাঝখানে। ফলে বছর বছর ড্রেন সংস্কার করতে গিয়ে রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়, যা জনভোগান্তি, যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ঢাকার পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এখানে মহাসড়ক বিভাগের তেমন কোনো কাজ নেই। ঢাকা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ড্রেনগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় গতকালের জলাবদ্ধতা ও যানজট পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে এ সময় মন্তব্য করেন তিনি।
সোর্স : ইনকিলাব